ডাক্তারি খৎনায় আতঙ্ক, ‘ভয়ের কারণ নেই’ বলছে চিকিৎকরা

স্বাস্থ্য ডেস্ক

ডাক্তারি খৎনায় রাজধানীতে দুই শিশুর মৃত্যুতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে অভিভাবকদের মধ্যে। তারা তাদের সন্তানদের খৎনা করাতে ভয় পাচ্ছেন। অভিভাবকদের অভিযোগ, শিশুর মৃত্যুর পরেও চিকিৎসকরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন না। ভুল চিকিৎসায় শিশুদের মৃত্যু হচ্ছে। অন্যদিকে চিকিৎসকরা এটিকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে দাবি করছেন। তারা জানিয়েছেন, এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

নিরাপত্তার কথা ভেবেই অভিভাবকরা এখন হাজামের পরিবর্তে চিকিৎসক দিয়ে খৎনা করান। এক সময় গ্রামাঞ্চলে হাজাম দিয়ে খৎনা করার প্রচলন থাকলেও এখন তার সংখ্যা কমেছে। আর শহরের অভিভাবকরা পুরোপুরি ডাক্তারদের ওপর নির্ভরশীল। তবে সম্প্রতি রাজধানীতে খৎনার সময় দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

অভিভাবকদের দাবি, ডাক্তার ও নার্সদের অবহেলার কারণে এমনটি ঘটছে। তারা নরমাল অ্যানেস্থেসিয়ার জায়গায় ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার কারণে শিশুদের মৃত্যু হচ্ছে। এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের বিচার হলে সমস্যাগুলোর সমাধান হবে।

মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাতে আহনাফ তাহমিন আয়হাম (১০) নামের এক শিশুর খৎনা করাতে মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান তার বাবা-মা। সেখানে অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জন ডা. এস এম মুক্তাদিরের তত্ত্বাবধানে রাত ৮টায় শিশুটিকে খৎনা করাতে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। এর ঘণ্টাখানেক পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

স্বজনদের অভিযোগ, নরমাল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার কথা থাকলেও ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয় আহনাফকে। যে কারণে তার জ্ঞান ফেরেনি।

আহনাফের বাবা ফখরুল আলম বলেন, আমরা চিকিৎসককে বলেছিলাম যেন ফুল অ্যানেস্থেসিয়া না দেওয়া হয়। তারপরও আমার ছেলের শরীরে সেটি পুশ করেন ডাক্তার মুক্তাদির। আমি বারবার তাদের পায়ে ধরেছি। আমার ছেলেকে যেন ফুল অ্যানেস্থেসিয়া না দেওয়া হয়। আমার সন্তানকে অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই মৃত্যুর দায় মুক্তাদিরসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবারই। আমি তাদের কঠোর শাস্তি চাই।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাজী শহীদ-উল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একজন রোগীকে পুরো অজ্ঞান করা সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। শতকরা হিসাবে সেটা ভগ্নাংশে হলেও যার জন্য ঘটে তার জন্য এটা শতভাগ। তাই কোনো রোগীকে অজ্ঞান করে অপারেশন করার আগে তার ফিটনেস যাচাই, ঝুঁকি পরিমাপ করা এবং রোগী কিংবা তার পরিবারের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করা প্রয়োজন। খৎনা করানোর সময়ও জেনারেল অ্যানেসথেসিয়াই বেশি ব্যবহার করা হয়।’

এদিকে এ ঘটনার মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টার সিলগালা করা হয়েছে। এ ছাড়াও দুই চিকিৎসককে আটক করেছে পুলিশ। শিশু মৃত্যুর ঘটনায় ডা. এস এম মুক্তাদিরসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন আইহামের বাবা। এ ছাড়া মামলায় পাঁচজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

এর আগে গত ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খৎনা করাতে গেলে পাঁচ বছর বয়সী শিশু আয়ান আহমেদকে অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আয়ানকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে টানা সাত দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গত ৮ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পরেই ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুই চিকিৎসক ও পরিচালককে আসামি করে রাজধানীর বাড্ডা থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী শিশুটির বাবা। এ ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম জনস্বার্থে শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় একটি রিট দায়ের করেন। একই সঙ্গে খৎনার জন্য অজ্ঞান করা শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকদের গাফিলতির অভিযোগ তদন্তে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

সবশেষ গত ১৫ জানুয়ারি শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করে সাত দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি দেশের সব অনুমোদিত ও অননুমোদিত হাসপাতাল-ক্লিনিকের তালিকা এক মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে।

সহকারী অধ্যাপক ডা. কাজী শহীদ-উল আলম আরও বলেন, ‘খৎনার জন্য জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার আগে অবশ্যই ঝুঁকিগুলো জেনে নিতে হবে। অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার জন্য রোগীর প্রি-অ্যানেসথেটিক চেকআপ হলো কি না দেখতে হবে। রোগীকে অজ্ঞান করার ৬ ঘণ্টা আগে থেকে শক্ত খাবার এবং ৪ ঘণ্টা আগে থেকে তরল খাবারসহ সব ধরনের খাওয়া বন্ধ করা জরুরি। এ ছাড়া রোগীর জন্মগত হার্ট, ফুসফুস, লিভারের সমস্যা থাকলেও পুরো অজ্ঞান করাটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই যার অপারেশন লাগবে তার জন্য জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া একমাত্র উপায় নাকি কোনো বিকল্প আছে তা ভেবে দেখা জরুরি।’

সাম্প্রতিক ঘটনায় অভিভাবকদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, ‘ডাক্তাররা ইচ্ছেকৃতভাবে কখনো রোগীদের মৃত্যু চায় না। তবে অনেক সময় হয়তো ভুলবশত কিছু দুর্ঘটনা ঘটে। সুন্নতে খৎতনায় ভয় নেই। তবে সন্তানকে সুন্নতে খতনা করানোর আগে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আছে কিনা তা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে সন্তানের শারীরিক অবস্থার দিকে খেয়াল রাখতে হবে অভিভাবকদের।’

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত