অ্যানেস্থেশিয়া যেন দিনে দিনে রোগীদের কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। সুন্নতে খাতনা করাতে গিয়ে অ্যানেস্থেশিয়ার ভুল প্রয়োগে শিশু আয়ানের মৃত্যু নিয়ে চলমান বিতর্কে এবার রাজধানীতে আরেক যুবকের মৃত্যু ঘটেছে। গতকাল সোমবার সকালে রাজধানীর ধানমন্ডি ল্যাবএইড হাসপাতালের আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চিকিৎসাধীন অবস্থায় কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে রাহিব রেজা (৩১) নামক এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। রাহিব গ্যাসের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসার জন্য ল্যাবএইড হাসপাতালে অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের কাছে যান। অধ্যাপক স্বপ্নীল রাহিবকে এন্ডোস্কোপি করানোর পরামর্শ দেন।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি ২০০৬ সাল থেকে গত ১৮ বছর ধরে ল্যাবএইড হাসপাতালে প্রাইভেট চেম্বার করে আসছেন।
দ্যুতি ছড়াচ্ছেন মেহজাবীনদ্যুতি ছড়াচ্ছেন মেহজাবীন
রোগীর স্বজনরা জানান, এন্ডোস্কোপি করাতে ল্যাবএইড হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে রাহিবকে ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় খালিপেটে উপস্থিত হতে বলা হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী ঠিক সময়ে ভোক্তভোগী রাহিব রেজা তার বন্ধু ফারহান ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে উপস্থিত হন। তারা ঠিক সময়ে হাসপাতালে উপস্থিত হলেও অধ্যাপক স্বপ্নীল না থাকায় তাদের অপেক্ষা করতে বলা হয়। এরপর রাত ১০টার দিকে অধ্যাপক স্বপ্নীল হাসপাতালে আসেন এবং হাতের কাজ শেষ করে রাত ১১টার দিকে তাড়াহুড়ো করে এন্ডোস্কোপি কক্ষে রাহিবকে নিয়ে যাওয়া হয়। এন্ডোস্কোপি কক্ষে নিয়ে যাওয়ার পর প্রায় দেড় ঘণ্টা পেরিয়ে যায় কিন্তু রাহিবকে বের করা হয় না। বিলম্ব হচ্ছে দেখে রোগীর এক স্বজন এন্ডোস্কোপি কক্ষে ঢুকে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখতে পান। অবস্থার অবনতি দেখে এন্ডোস্কোপি কক্ষ থেকে তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার তিনি মারা যান।
রাহিব রেজার বন্ধু ফারহান ইসলাম বলেন, হাঁটতে হাঁটতে যে বন্ধুকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম তাকে আজ লাশ বানিয়ে নিয়ে ফিরতে হলো। আমার বন্ধুর মৃত্যুর পেছনে ডাক্তার স্বপ্নীল দায়ী। তিনি অ্যানেস্থেশিয়া করার আগে রাহিবের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে যে পরীক্ষা করানো হয়েছিল তার রিপোর্টগুলো ভালো করে পড়েও দেখেননি। তাড়াহুড়ো করে বাহির থেকে আসলেন এবং হাতের কাজ শেষ করে রাহিবকে এন্ডোস্কোপি কক্ষে নিয়ে যান। রিপোর্ট ঠিকভাবে না দেখেই অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে এন্ডোস্কোপি শুরু করে দেন আর এই কারণেই তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়।
তিনি বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে রাহিবের রিপোর্টগুলো অন্য চিকিৎসককে দেখানো হয়। সেই চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রাহিবের শারীরিক অবস্থা এন্ডোস্কোপির জন্য ফিট ছিল না। এ কারণেই তার হার্ট ফেইলিউর হতে পারে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, আমি গত ২০ বছর ধরে চিকিৎসা পেশায় আছি। এই ল্যাব এইডের একই কক্ষে বসে গত ১৮ বছর ধরে প্রাইভেট চেম্বার করছি। আমার বিরুদ্ধে চিকিৎসা অবহেলার কোনো প্রমাণ নেই। এই রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে এন্ডোস্কোপি করেছি, কোনো অ্যানেস্থেশিয়া দিইনি। এন্ডোস্কপি শেষ করার পরও তার কোনো জটিলতা দেখা যায়নি। এরপর যখন অন্য রুমে নেওয়া হয় এর কিছুক্ষণ পর নার্সরা জানান রোগীর পালস পাওয়া যাচ্ছে না, অক্সিজেন পাচ্ছে না, তার অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এ সময় তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে।
একটা রোগী মারা যাওয়া চিকিৎসকের জন্য বেদনার উল্লেখ করে ডা. স্বপ্নীল বলেন, এই বয়সে একটা ছেলে মারা গেছে আমি সত্যিই ব্যাথিত। আমি যে কইয়দিন রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিল তার নিয়মিত খবর নিয়েছি। শুরুতে তার অবস্থা খারাপ হলে তার স্বজনদের জানাই এবং আইসিইউতে নেওয়ার কথা বলি। তার চিকিৎসায় ছয় সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন পর্যন্ত করা হয়েছিল। এই ছয়জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাকে চিকিৎসা দিয়েছেন। আপনি তাদের সঙ্গে কথা বললেই জানতে পারবেন আমার কোনো অবহেলা ছিল না।
এদিকে ল্যাবএইড হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা চৌধুরী মেহের-এ-খোদা একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এন্ডোস্কোপির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের তত্ত্বাবধানে হয়েছে। যে অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট অ্যানেস্থেশিয়া দিয়েছেন, তিনি ডা. স্বপ্নীলের ব্যক্তিগত অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট। তিনি আমাদের হাসপাতালের কেউ নন।
এ বিষয়ে ডাক্তার স্বপ্নিল বলেন, এ কথা কে বলেছেন আমি জানি না। তিনি সত্য তথ্য দেননি।
ভয়ার্ত চেহারায় মাধবনভয়ার্ত চেহারায় মাধবন
এর আগে রাজধানীর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় আয়ান নামের ৫ বছরের এক শিশু মারা যায়। গত ৩১ ডিসেম্বর সুন্নতে খতনা করানোর জন্য আয়ানকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়াই তাকে ফুল অ্যানেস্থেশিয়া (জেনারেল) দিয়ে সুন্নতে খাতনা করান চিকিৎসক। খতনা শেষ হওয়ার পর আয়ানের জ্ঞান না ফেরায় তাকে সেখান থেকে পাঠানো হয় গুলশান-২ এর ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানে পিআইসিইউতে (শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। গত ৮ জানুয়ারি শিশু আয়ান মারা যায়।