পৃথিবীর ইতিহাসে এমন এক শুভ দিন আছে, যেদিন আকাশ-পাতাল, দিগন্ত, সমুদ্র, পাহাড় ও মরু যেন নব নব আনন্দে মুখরিত হয়েছিল। সেদিনই জন্মগ্রহণ করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। আমরা যাকে ভালোবাসার ভাষায় বলি—রহমাতুল্লিল আলামিন, সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য রহমতের উৎস। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) সেই দিনকে স্মরণ করার দিন; সেই দিনকে উপলব্ধি করার দিন; সেই দিন, যেদিন অন্ধকার ভেদ করে আলো জেগেছিল মানবসভ্যতার বুকে।
নবী করীম (সা.)-এর জন্ম হয়েছিল এমন এক যুগে, যখন সমাজ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। আরবের মরুভূমি ছিল কন্যা সন্তান হত্যার অভিশাপে কলুষিত, মানুষ বিভেদ ও গোত্রীয় হিংসায় নিমজ্জিত, নৈতিকতা ও ন্যায়নীতি ছিল বিলুপ্তপ্রায়। ধনীরা গরিবদের শোষণ করত, দুর্বলের কোনো অধিকার ছিল না। চারদিকে বিস্তার লাভ করেছিল অবিচার, অমানবিকতা ও অজ্ঞতা। পৃথিবী যেন ডাকছিল এক আলোকবর্তিকার, ডাকছিল এক ত্রাণকর্তার। আর সেই আহ্বানের জবাবেই প্রেরিত হলেন প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.)।
তিনি পৃথিবীতে এসে প্রথমে নিজেকে গড়ে তুললেন এক পরিপূর্ণ মানব হিসেবে। “আল-আমিন” খেতাব তিনি অর্জন করেছিলেন তাঁর সততা, বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতার জন্য। তাঁর নবুওয়াতের সূচনা হলো হেরা গুহার নিভৃত নির্জনতায়, যেখানে আল্লাহর বাণী নাযিল হলো—“ইক্রা”—পড়ো। সেই প্রথম ওহী ছিল মানবজাতির শিক্ষা, জ্ঞান ও সত্যের দিকে আহ্বান।
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন সংগ্রামের ইতিহাস মানবসভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ দলিল। তিনি নিপীড়ন সহ্য করেছেন, মক্কার অবিশ্বাসীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন, তবুও প্রতিশোধ নেননি। বরং ক্ষমা করেছেন। তায়েফের মাটিতে যখন তিনি রক্তাক্ত হয়ে পড়েছিলেন, তখন ফেরেশতারা চাইলে পুরো নগর ধ্বংস করে দিতে পারত। কিন্তু নবীজির উত্তর ছিল—“না, হয়তো এদের সন্তানদের মধ্য থেকে কোনো একদিন ঈমানদার উত্থিত হবে।” এ হলো দয়ার, ধৈর্যের, ক্ষমার এক মহামহিম উদাহরণ।
মদিনায় হিজরত করার পর তিনি গড়ে তুলেছিলেন এমন এক সমাজব্যবস্থা, যা আজও মানবাধিকার, সমতা ও ন্যায়নীতির সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। মদিনা সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান, যেখানে মুসলিম ও অমুসলিম সকল নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। নবীজির শিক্ষা কেবল ধর্মীয় সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য কল্যাণের পথপ্রদর্শক।
আজকের পৃথিবী যখন ভ্রান্ত মতাদর্শ, সহিংসতা, সন্ত্রাস, বিভাজন ও বৈষম্যে জর্জরিত, তখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নবীজির আদর্শে ফিরে যাওয়া। তাঁর শিক্ষা হলো শান্তি, ভ্রাতৃত্ব, সমতা, দয়া ও ক্ষমা। নবীজি শিখিয়েছেন—“সকল মানুষই আদম ও হাওয়ার সন্তান, তোমাদের মধ্যে কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব অ-আরবের উপর নেই, নেই ধনীর শ্রেষ্ঠত্ব দরিদ্রের উপর; শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়ায়।”
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আমাদের জন্য কেবল আনন্দের দিন নয়, এটি আমাদের আত্মশুদ্ধির দিন, নবীর দেখানো পথ অনুসরণের শপথের দিন। এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার করতে হবে—
* আমরা অন্যায়কে না বলব,
* অন্যকে ভালোবাসব,
* দরিদ্র ও অসহায়দের পাশে দাঁড়াব,
* সত্য, ন্যায় ও শান্তির পথে চলব,
* নবীজির সুন্নাহ ও আদর্শকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।
প্রিয়নবীর জন্মবার্ষিকী আমাদের মনে করিয়ে দেয়—অন্ধকারের পরে আলো আসবেই। অন্যায়ের পরে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবেই। দ্বিধা-বিভক্তির পরে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের সূর্যোদয় ঘটবেই।
আসুন, এই পবিত্র দিনে আমরা সবাই নবীজি (সা.)-এর জন্য দরুদ পাঠ করি, তাঁর প্রতি আমাদের অন্তরের ভালোবাসা নবায়ন করি এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি—
“হে আল্লাহ, আমাদের জীবনকে নবীর শিক্ষা অনুযায়ী সাজানোর তৌফিক দিন, আমাদের সমাজকে শান্তি, ন্যায় ও ভ্রাতৃত্বের পথে ফিরিয়ে আনুন, এবং আমাদের অন্তরে প্রিয় নবীর প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা স্থায়ী করুন।”
শুভ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)।
🖊️
এম. সাদ্দাম হোসাইন সাজ্জাদ
এডিটর ইন চীফ- একুশে বুলেটিন







