জিম্মি জাহাজে অভিযান প্রস্তুতি, দস্যু আটক ও সবশেষ তথ্য

বিবিসি বাংলা

এমভি আব্দুল্লাহ ও জিম্মি নাবিকদের জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করতে সোমালি পুলিশ ও আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে পান্টল্যান্ড অঞ্চলের পুলিশ। তবে জিম্মি নাবিকদের নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার এবং জাহাজটির মালিক কর্তৃপক্ষ তাতে সায় দেয়নি। জিম্মিদের স্বজনরাও অভিযানের বিপক্ষে।
সোমালি জলদস্যুদের অপহরণের শিকার বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আব্দুল্লাহ’র জিম্মি নাবিকদের পরিবারগুলো জানিয়েছে, দস্যুরা এখন যেন অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

জলদস্যুরা গত সপ্তাহে ভারত মহাসাগরে জাহাজটি দখলে নেয়ার পর এ ক’দিন নাবিকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগসহ কিছু সুবিধা দিলেও গত দু’দিনে তারা তা-ও বন্ধ করে দিয়েছে।

এদিকে জলদস্যুদের কবল থেকে জাহাজটি উদ্ধারে অভিযান পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও নাবিকদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে তাতে সায় দেয়নি বাংলাদেশ।

এর আগে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, এমভি আব্দুল্লাহ ও জিম্মি নাবিকদের জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করতে সোমালি পুলিশ ও আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে পান্টল্যান্ড অঞ্চলের পুলিশ।

এছাড়া রোববার এমভি আব্দুল্লাহ ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত হিসেবে অভিযুক্ত দুই জলদস্যুকে আটকের কথা জানিয়েছে পান্টল্যান্ড পুলিশ।

জিম্মি নাবিকদের পরিবার যা বলছে:

জিম্মি নাবিকরা তাদের পরিবারকে জানিয়েছেন, জলদস্যুরা জাহাজে থাকা খাবার শুধু খাচ্ছেই না, সেগুলো নষ্টও করছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানান নাবিকরা।

জিম্মি থাকা ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের সঙ্গে তার বড় ভাই ওমর ফারুকের সবশেষ কথা হয় দু’দিন আগে।

ওমর ফারুক মঙ্গলবার জানান, তখন সে জানিয়েছিল যে জলদস্যুরা প্রতিদিন প্রায় একশ’জনের খাবার নষ্ট করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বড় সংকটে পড়তে হবে তাদের।

এমন পরিস্থিতিতে এমভি আব্দুল্লাহ ও জিম্মি নাবিকদের জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করতে সোমালি পুলিশ এবং আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ভারতীয় কমান্ডোরা জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েনে অভিযান চালিয়ে ১৭ ক্রুকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করার পর এমভি আব্দুল্লাহতেও অভিযানের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

তবে এ ধরনের অভিযানের প্রস্তাবে বাংলাদেশের সরকার রাজি হয়নি।

জাহাজটির মালিক কোম্পানি কেএসআরএম গ্রুপও এ ধরনের অভিযানে রাজি নয়। প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘নাবিক ও ক্রুদের জীবন বিপন্ন হয় এমন কোনো অপারেশন আমরা চাই না।’

জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের মা শাহানুর বেগম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ভারতীয় নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার দেখার পর থেকে ওরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে আমরা জেনেছি। অভিযান চললে আমরা আর আমাদের সন্তানদের জীবিত ফেরত পাব না। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।’

জাহাজটির অবস্থান এখন কোথায়?

পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা জাহাজটির সবশেষ অবস্থান মনিটর করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পাশাপাশি বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনও (বিএমএমওএ) জাহাজটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে।

জলদস্যুরা ইতোমধ্যে জাহাজটিকে নিয়ে কয়েক দফায় ভারত মহাসাগরে স্থান পরিবর্তন করেছে।

জাহাজটির এই গতিপথ ও অবস্থান দেখে বিএমএমওএ বলছে, নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর প্রথমেই জলদস্যুরা বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজটিকে দেড় দিনের মাথায় সোমালিয়া উপকূলের কাছাকাছি নিয়ে যায়।

জলদস্যুদের কবলে পড়ার পরদিন বুধবার এটি ছিল সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু উপকূলের কাছাকাছি অবস্থানে। পরবর্তীতে সেটিকে আরও উত্তর দিকে সরিয়ে প্রথমে নেয়া হয় গারদাকে।

এরপরই ভারতীয় নৌবাহিনী জাহাজটি ঘিরে নজরদারি বাড়ালে সেটি আবারও সরিয়ে নেয়া হয় গদবজিরান উপকূলে।

তিনদিন ধরে জাহাজটি একই জায়গায় নোঙ্গর করে আছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। তারা জানাচ্ছে, জাহাজটি গদবজিরান শহর থেকে ৪ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে।

অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘এমভি আব্দুল্লাহ যে জায়গায় ছিল গত তিনদিন ধরে সেখানেই আছে। আমরা আশা করছি এখানে থেকেই তারা মালিকপক্ষের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করবে।’

ফুরিয়ে আসছে খাবার, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পরিবার:

আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরের সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ।

জিম্মি হওয়ার দু’দিন পর্যন্ত জাহাজটির অবস্থানসহ বিভিন্ন তথ্য পরিবারের কাছে জানানোর সুযোগ পেয়েছিলেন জিম্মি নাবিকরা। কিন্তু গত দু’দিন ধরে সে যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে।

এই জাহাজে থাকা তিনজন জিম্মি নাবিকের পরিবারের সঙ্গে মঙ্গলবার কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। তারা জানিয়েেছন, গত দু’দিনে জাহাজ থেকে তাদের সঙ্গে স্বজনরা যোগাযোগ করেননি।

সবশেষ শনিবার চিফ অফিসার ক্যাপ্টেন আতিকুল্লাহ খানের সঙ্গে তার পরিবারের লোকজনের কথা হয়।

আতিকুল্লাহ খানের মা শাহানুর বেগম বলেন, ‘শেষ যখন কথা হয়েছে তখন ছেলে আমাকে বলেছে যে ওরা গায়ে হাত না দিলেও অনেক দুর্ব্যবহার করা শুরু করেছে।

‘বিশেষ করে ভারতীয় নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার টহল দেখার পর থেকে জলদস্যুদের আচরণে পরির্বতন হয়েছে।’

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর খাবার ও পানি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এর মধ্যে জিম্মি নাবিকদের খাবারে ভাগ বসাচ্ছে সশস্ত্র জলদস্যুরা।

সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার তৌফিকুল ইসলামের শ্যালক সিব্বির মাহমুদ বলেন, ‘শনিবারের পর থেকে আমাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। এ নিয়ে পুরো পরিবার দুশ্চিন্তায় আছি।’

এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ। কয়েক দফায় দস্যুরা জাহাজে আসা-যাওয়া করছে। প্রায় সব সময় জাহাজে থাকছে ৩০-৪০ জন জলদস্যু। তারা নিয়মিত জাহাজের খাবার খাচ্ছে বলেও নাবিকরা তাদের পরিবারকে জানিয়েছেন।

জিম্মি ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের বড় ভাই ওমর ফারুক বলেন, ‘আমার ভাই সবশেষ দু’দিন আগে ফোন দিয়েছিলেন। তখন জানিয়েছিলেন যে জিম্মি আব্দুল্লাহর নাবিকদের সবচেয়ে বড় ভয় খাদ্য ও পানি সংকট।

‘কারণ সোমালি জলদস্যুরা খাবার শুধু খাচ্ছে না। তারা প্রতিবেলায় খাবার নিয়ে সেগুলো আবার নষ্ট করছে। প্রতিবেলায় গড়ে একশ’জনের খাবার নষ্ট হচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে খুব শিগগির জাহাজে খাদ্য ও পানি সংকট দেখা দেবে।’

উদ্ধারে আন্তর্জাতিক অভিযান?

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, এমভি আব্দুল্লাহ ও জিম্মি নাবিকদের জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করতে সোমালি পুলিশ ও আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে দেশটির পান্টল্যান্ড অঞ্চলের পুলিশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় কমান্ডোরা জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েনে অভিযান চালিয়ে ১৭ ক্রুকে উদ্ধারের পর এমভি আবদুল্লাহতে অভিযানের এই পরিকল্পনা করা হয়েছে।

সোমালিয়ার একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পান্টল্যান্ডের পুলিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, এমভি আব্দুল্লাহকে দখল করে থাকা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর অভিযানের একটি পরিকল্পনা তারা জানতে পেরেছে। সে কারণে তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং অভিযানে অংশ নিতেও প্রস্তুত রয়েছে।

এর আগে রোববার এমভি আব্দুল্লাহ ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত দুজনকে আটকের কথাও জানায় পাটল্যান্ড পুলিশ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত মহাসাগরে দস্যুদের কবলে থাকা জাহাজ ও নাবিকদের কোনো ধরনের ক্ষতি ছাড়া অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা যাবে কীনা?

এমন প্রশ্নে বাংলাদেশের স্পষ্ট জবাব- না। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে উদ্ধার অভিযানে গেলে প্রাণহানির আশঙ্কা বেশি থাকবে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘মাল্টার জাহাজ রুয়েন তিন মাস আগে দস্যুদের কবলে পড়েছিল। সেই জাহাজের প্রেক্ষাপট আর বাংলাদেশের জাহাজের প্রেক্ষাপট এক না।

‘রুয়েনের মতো একই প্রক্রিয়ায় এমভি আব্দুল্লাহ উদ্ধার করা সম্ভব না। কেননা, বাংলাদেশি জাহাজটি কয়লাবাহী। উদ্ধার অভিযানের সময় গোলাগুলি হতে পারে। সেটি যদি হয় তাহলে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকেই। কেননা কয়লাবাহী জাহাজ মেরিটাইম খাতে ঝুঁকিপূর্ণ কার্গো হিসেবে পরিচিত।’

জিম্মি নাবিকদের পরিবারও এই ধরনের অভিযান না চালানোর অনুরোধ জানিয়েছেন।

চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের মা বলেন, ‘আমরা কোনো যুদ্ধ করে সন্তান ফেরত চাই না। এমনিতেই টহলের হেলিকপ্টার দেখার পর থেকে দস্যুরা জিম্মিদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। আমরা চাই মুক্তিপণের মাধ্যমে ওদের ফেরত আনা হোক।’

বাংলাদেশি জাহাজটির মালিকপক্ষও এমন অভিযানের পক্ষে না। আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের অভিযানের প্রস্তাব এলে তা নাকচ করা হবে বলেও জানিয়েছে কেএসআরএম গ্রুপ।

কেএসআরএম-এর মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। অভিযান নয়, আমরা শান্তিপূর্ণ যে কোনো উপায়ে অক্ষত অবস্থায় নাগরিকদের ফেরত আনতে চাই।’

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত