- সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে মিলছে না ব্রয়লার মুরগি
- ব্রয়লারের দাম নির্ধারণে ভূমিকা কয়েকটি কোম্পানির
প্রতিটি মুরগির গাড়িকে তিন ধরনের চাঁদা দিতে হয়
প্রতিটি মুরগির গাড়িকে তিন ধরনের চাঁদা দিতে হয়
গত শুক্রবার ২৯টি পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে একটি তালিকা প্রকাশ করে সরকার। সেখানে ব্রয়লার মুরগির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭৫ টাকা প্রতি কেজি। অথচ গতকাল শান্তিনগরসহ রাজধানীর অধিকাংশ বাজারেই এক কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ২২০ টাকা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ৪৫টা টাকা যায় কোথায়?
সরেজমিন তথ্য বলছে, গতকাল শান্তিনগর বাজারের বিক্রমপুর ব্রয়লার হাউস থেকে তিন কেজি ১০০ গ্রাম মুরগির মাংস কেনেন মাসুদ হাওলাদার (ছদ্মনাম)। দাম রাখা হয় ৬৮২ টাকা। বিক্রেতাকে প্রশ্ন করা হয়, সরকার তো নির্ধারিত দাম বেঁধে দিয়েছে তাহলে ৪৫ টাকা বেশি কেন? সদুত্তর নেই।
এই বাজারের অন্তত ৭-৮টি দোকানে ঠিক একই দামে মুরগি বিক্রি হচ্ছে। তবে সরকার যে দাম বেঁধে দিয়েছে তার চেয়ে হিসেবে অন্তত ১০০ টাকা বেশি মাসুদ হাওলাদারকে পকেট থেকে গুনতে হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, মুরগি কেটে সাফ-শুদ্ধ করার পর মাসুদ হাওলাদারের হাতে যখন মাংস আসে, তখন তা দাঁড়ায় দুই কেজি ৩০০ গ্রাম। অর্থাৎ এখানে নেই ৮০০ গ্রাম। মানে ১৭৬ টাকা নেই। ফলে মাসুদ হাওলাদারের মতো প্রত্যেক মুরগি ক্রেতাকে প্রতি কেজি মুরগি কিনতে হচ্ছে অন্তত ২৯৬ টাকায়।
বিক্রমপুর ব্রয়লার হাউসের পাশেই বিসমিল্লাহ ব্রয়লার হাউস। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই দোকানি বলেন, ৪৫ টাকার খোঁজ নিতে হলে আপনাকে কাপ্তান বাজার থেকে শুরু করতে হবে।
সরেজমিন তথ্য বলছে, অন্তত তিন ধরনের চাঁদা আদায় হয়। এই চাঁদা কাপ্তান বাজার থেকে শান্তিনগর বাজারে আসা পর্যন্ত দিতে হয়। এর মধ্যে বাজার থেকে মুরগির গাড়ি বের হলেই গাড়ি প্রতি ১০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। এই টাকা কোথায় কোথায় যায় তার কোনো হদিস নেই। চাঁদা আদায়কারীরা দাবি করেন, বাজার কমিটি, স্থানীয় ক্ষমতাসীন নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পকেটে যায় এর ভাগ।
গাড়ি বের হলে রাস্তায় একবার ও শান্তিনগর বাজারে আসার পর দুই দফা টাকা দিতে হয়। সব মিলিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দাবি, গাড়ি প্রতি টাকা দিতে হয় অন্তত ৩০০ টাকা। সঙ্গে গাড়ি ভাড়া, দোকান ভাড়া, শ্রমিক ও মালিকের লভ্যাংশ যোগ হয়। এরপর দাম নির্ধারণ করে ক্রেতার কাছে মুরগি বিক্রি হয়।
অথচ শুক্রবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া দামেই ২৯টি পণ্য কেনাবেচা করতে হবে।
খুচরা বিক্রেতাদের এই ছলাকলার আগে আরও কয়েক ধাপে দাম বাড়ানো হয় ব্রয়লার মাংসের। আর এর মূল কলকাঠি নাড়ে বাজারে থাকা প্রভাবশালী কয়েকটি কোম্পানি।
তথ্য বলছে, ব্রয়লারের জিপি স্টকের বাজারে শীর্ষ পাঁচ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ৮৫ শতাংশ। জিপি হচ্ছে গ্র্যান্ড প্যারেন্ট স্টক। পোলট্রি খাতে মাংস ও ডিমের জন্য মুরগির একদিন বয়সী বাচ্চা কিনে থাকেন খামারিরা। প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে যেসব বাচ্চা মোরগ-মুরগির মাধ্যমে উৎপাদন হয়; সেগুলোকে বলা হয় প্যারেন্ট স্টক (পিএস)। আর পিএস উৎপাদন হয় (জিপি) থেকে। দেশে এই জিপি ও পিএসের বাজারের পুরোটাই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণে।
বাজারে বর্তমানে যে কয়টি প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবশালী হিসেবে দেখা হয় সেগুলোর মধ্যে আছে কাজী ফার্মস গ্রুপ, নারিশ, প্যারাগন, আফতাব, কোয়ালিটি, প্রোভিটা, সিপি, ডায়মন্ড এগ, রাশিক/জামান গ্রুপ ইত্যাদি।
২০২০ সালে ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাস দেশের পোলট্রি খাতে করপোরেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এক গবেষণা চালায়। ‘পোলট্রি সেক্টর স্টাডি বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে আসে, দেশে মাংসের জন্য পালন করা ব্রয়লার মুরগির জিপি স্টক সবচেয়ে বেশি রয়েছে কাজী ফার্মস গ্রুপের। দুটি খামারে তাদের ৪৯ হাজার জিপি ব্রয়লার রয়েছে। ব্রয়লারের জিপির বাজারের ৩৪ শতাংশই প্রতিষ্ঠানটির দখলে।
কাজী ফার্মসের মতোই প্যারাগন, আফতাব, নারিশ ও সিপিও একই সঙ্গে খাদ্য, বাচ্চা, ডিম ও মাংস উৎপাদন করে থাকে। প্যারাগন গ্রুপের দুটি খামারে ব্রয়লারের জিপি রয়েছে ১৪ হাজার। জিপি ও লেয়ার ফার্মের সংখ্যা তিনটি। প্রতিষ্ঠানটির জবাইখানায় সক্ষমতা একদিনে পাঁচ হাজার। হ্যাচারি রয়েছে সাতটি। আর খাদ্য উৎপাদন কারখানা রয়েছে পাঁচটি।
এই কোম্পানিগুলো মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রয়লারের দাম নির্ধারণ করে। ওই নির্ধারিত দামের পর পণ্য যায় ডিলারদের কাছে। ডিলারদের কাছ থেকে পণ্য পাইকাররা কিনে বিভিন্ন বাজারে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে খুচরা বিক্রেতারা পণ্য কেনেন। ফলে অন্তত চার হাত ঘুরে পণ্যের দাম বেড়ে যায় অন্তত তিনগুণ। ৭০ থেকে ৮০ টাকা উৎপাদনকারীরা বিক্রি করলে সেটি বিভিন্ন হাত ঘুরে বাজারে ২২০ টাকায় বিক্রি হয়। অথচ ঘুরেফিরে যার যার লভ্যাংশ ঠিক থাকলেও পকেট কাটা পড়ে সাধারণ মানুষের।