স্পিড মানি ছাড়া কোনো কাজই হয় না সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে

নিজস্ব প্রতিবেদক

  • চট্টগ্রামের ২২ সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়
  • ঘুষ দেওয়া নেওয়ায় নেই কোনো আড়াল

 

ঘুষ ছাড়া দলিল রেজিস্ট্রি (নিবন্ধন) হচ্ছে না চট্টগ্রামের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে। রেজিস্ট্রি ছাড়াও দলিলের নকল কপি তোলা এবং দানপত্র, বণ্টনপত্র, ঘোষণাপত্র, অংশনামা ও চুক্তিপত্রের মতো দলিল সম্পাদনেও সেবাগ্রহীতাদের দিতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের ঘুষ। এক কথায় ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হয় না সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে। জমির দলিল নিবন্ধনে সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে দলিলে উল্লিখিত জমির দামের ওপর কার্যালয়-ভেদে প্রতি হাজারে সর্বনিম্ন ৩ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ টাকা করেও নেওয়া হচ্ছে। প্রতি হাজারে গড়ে এই ঘুষের টাকার হার ৬ টাকা বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। আর দলিল লেখকদের মাধ্যমে আদায় করা ঘুষের এই টাকার ভাগ পিওন থেকে শুরু করে জেলা রেজিস্ট্রার পর্যন্ত পান বলে অভিযোগ রয়েছে।

কয়েক দিন ধরে জেলার বেশ কয়েকটি সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় ঘুরে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছেন এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেনের দুটি ভিডিও ক্লিপ ও কিছু একুশে বুলেটিনের হাতে রয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার এবং চট্টগ্রাম জেলা দলিল লেখক সমিতির একাধিক নেতার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে জেলার ২২টি ভূমি রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে দলিল রেজিস্ট্রি হয়েছে ১০ হাজার ২৭৫টি। এসব দলিলে উল্লিখিত জমির দামের প্রতি হাজারে গড়ে ঘুষ আদায় হয়েছে ৬ টাকা হারে। এ হিসেবে শুধু গত ডিসেম্বর মাসে ঘুষ আদায় হয়েছে অন্তত ৫৫ লাখ টাকা। সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের পিওন থেকে শুরু করে প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। ঘুষের টাকার ৫০ শতাংশ পান সাব-রেজিস্ট্রার। বাকি টাকা অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা হয়।

গত ৩১ জানুয়ারি বেলা দেড়টার দিকে হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, নিবন্ধনের আগে দলিল ঘেঁটে দেখার পর কার্যালয়ের মোহরার সৈয়দ আজগর আলী ও কর্মচারী ফেরদৌস দলিল লেখকদের কাছ থেকে প্রকাশ্যে ঘুষের টাকা নিচ্ছেন। এর আগে গত ২৩ জানুয়ারি দুপুরে ওই অফিসে গিয়ে ঘুষ গ্রহণের একই চিত্র দেখতে পান এই প্রতিবেদক। এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে মোহরার সৈয়দ আজগর আলীর মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তার সাড়া মেলেনি। একাধিক দলিল লেখক জানান, সরকার নির্ধারিত ফি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার কথা বললে সংশ্লিষ্টরা নানা অজুহাত দেখান। আর শুধু জমি রেজিস্ট্রি নয়, বাধ্য হয়ে দানপত্র, বণ্টনপত্র, ঘোষণাপত্র, অংশনামা ও চুক্তিপত্রের মতো দলিল সম্পাদনের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে ৫০-৬০ গুণ বেশি টাকা দিতে হচ্ছে দাতা-গ্রহীতাদের। তারা আরও জানান, শুধু নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ঘুষ নয়, একেকটি দলিলের নকল (অনুলিপি) সংগ্রহ করতেও সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ৫০০/৬০০ টাকা।

মো. ইলিয়াছ নামে এক দুবাই প্রবাসী জানান, ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ফতেয়াবাদ সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে তার একটি হেবানামা দলিল (৫৭৮১) নিবন্ধন হয়। দুই মাস আগে ওই দলিলের মূল কপি সংগ্রহ করতে যান ফতেয়াবাদ সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে। এ সময় মূল কপি সরবরাহ করতে তার কাছে আড়াই হাজার টাকা দাবি করেন মোহরার সৈয়দ আজগর আলী। পরে দুই হাজার টাকা দিয়ে মূল কপি সংগ্রহ করেন। চলতি মাসে একই অফিসে নিবন্ধিত একটি দলিলের (৬০/২৪) নকল পেতে অতিরিক্ত ১ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট দলিল গ্রহীতার। একই অফিসে নিবন্ধিত অন্য একটি দলিলের (২০৭০) নকল সরবরাহ দেওয়া হয়েছিল গত বছরের ২২ জুন। এতে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, কোর্ট ফিসহ সরকারি ফি আসে ১ হাজার ৫০ টাকা। কিন্তু দলিল গ্রহীতার কাছ থেকে অতিরিক্ত নেওয়া হয় ৬৫০ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সাব-রেজিস্ট্রার চিং মং থোয়াই সপ্তাহে তিনদিন ফতেয়াবাদ এবং দুই দিন হাটহাজারী সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করেন। এই দুটি অফিসে দলিল রেজিস্ট্রি হয় সপ্তাহের পাঁচদিনে ১০০ থেকে ১৫০টি। আর এই পাঁচ দিনে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা ঘুষ আদায় হয়। দুই কার্যালয়ের প্রধান সহকারী ও মোহরার এই টাকা আদায় করেন বলে অভিযোগ। প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে ঘুষের ওই টাকার ভাগবাটোয়ারা করেন তারা। এর মধ্যে সাব-রেজিস্ট্রার চিং মং থোয়াই পান ৫০ শতাংশ। এই অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চিং মং থোয়াইয়ের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও সাড়া মেলেনি।

দলিল নিবন্ধন ও নকল সরবরাহে ঘুষ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে সদর সাব-রেজিস্ট্রি ও চান্দগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে গিয়েও। গত বুধবার দুপুরে সদর কার্যালয়ে ৪ শতাংশ জমি নিবন্ধন করতে যান চকবাজার এলাকার এক বাসিন্দা। তার দলিলে উল্লিখিত টাকার পরিমাণ ছিল ৬০ লাখ। সরকারি যাবতীয় কর প্রদানের পরও দলিলটি নিবন্ধন করতে তার কাছ থেকে অতিরিক্ত আদায় করা হয় ৩০ হাজার টাকা।

নকল সরবরাহে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের প্রমাণ মেলে সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। গত বুধবার বিকেলে একটি হেবানামা দলিলের অনুলিপি সরবরাহ করতে কত টাকা লাগবে জানতে চাইলে ওই কার্যালয়ের নকলনবিশ রাজীব মল্লিক বলেন, ‘প্রথম দুই পাতা দেড় হাজার টাকা। পাতা বাড়লে টাকাও বাড়বে।’

চট্টগ্রাম নগরীর মোহরা এলাকার বাসিন্দা এক নারী ছোট ভাইকে জমির দলিল হস্তান্তরের পর সেটা নিবন্ধনের জন্য গত বুধবার দুপুরে চান্দগাঁও ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে যান। এ সময় তার নিয়োজিত দলিল লেখককে জানিয়ে দেওয়া হয়, সরকার নির্ধারিত ফিতে কোনো নিবন্ধন করা যাবে না। শুরুতে রাজি না হলেও পরে বাধ্য হয়ে ৩৫ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে দলিল নিবন্ধন করতে হয় ওই নারীকে।

দলিল নিবন্ধনে দুর্নীতির প্রসঙ্গে টিআইবি, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘সাব-রেজিস্ট্রার অফিসগুলোয় অসহায় মানুষের টুঁটি চেপে ধরে দুর্নীতি করছেন সাব-রেজিস্ট্রাররা। সব ঠিক থাকার পরও নানা অজুহাতে প্রতি মাসে অর্ধকোটি টাকার বেশি ঘুষ আদায় হচ্ছে। এর আগে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন মাহমুদের উপস্থিতিতে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি আমি তুলে ধরেছিলাম। এ সময় তৎকালীন জেলা রেজিস্ট্রার বিষয়টি অস্বীকার করলে তাকে শাসান দুদক চেয়ারম্যান।’

সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে দলিলের অনুলিপি সরবরাহ করতে অতিরিক্ত কিছু টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন জেলা রেজিস্ট্রার (নিবন্ধক) মিশন চাকমা। তবে দলিল নিবন্ধন ও নকল সরবরাহে ঘুষ লেনদেনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে দুর্নীতি যে হচ্ছে না, এ কথা আমি হলফ করে বলব না। তবে অভিযোগ হতে হবে সুনির্দিষ্ট। টিআইবির জরিপের ভিত্তি নেই।’

দলিল নিবন্ধনে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় সম্প্রতি হাটহাজারীর সাব-রেজিস্ট্রার পারভীন আক্তার ও প্রধান সহকারী দিদারুল আলমকে সাময়িক চাকরিচ্যুত করা হয়েছে জানিয়ে জেলা রেজিস্ট্রার মিশন চাকমা বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তবে অভিযোগ আছে, প্রতি মাসের ১ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে জেলার ২২টি সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে জেলা রেজিস্ট্রার মিশন চাকমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় ঘুষের ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোর প্রধান সহকারীরা এই টাকা পৌঁছে দেন। অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা রেজিস্ট্রার মিশন চাকমা বলেন, ‘এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। কে, কখন আমার কাছে টাকা পৌঁছে দেয়, তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে দেন।’

দলিল নিবন্ধন ও নকল সরবরাহে অনিয়ম চলছে বলে স্বীকার করেন চট্টগ্রাম দলিল লেখক সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ঘুষ লেনদেন যে হচ্ছে না তা আমি বলব না। সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে দলিল লেখকরা সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে যে যার মতো করে কাজ সেরে নেন। তবে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই।’

ডিসেম্বর মাসের রাজস্ব : জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের ২২টি নিবন্ধন অফিসে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে দলিল রেজিস্ট্রি হয়েছে ১০ হাজার ২৭৫টি। এতে রেজিস্ট্রেশন ফি আদায় হয়েছে ৯ কোটি ৪৮ লাখ ৬৫ হাজার ৪২৫ টাকা। দলিলের অনুলিপি (নকল) বাবদ ফি আদায় হয়েছে ৪৫ লাখ ১১ হাজার ২৮৮ টাকা। তল্লাশি, পরিদর্শন ফি ৩৮ লাখ ৭ হাজার ৪৫১ টাকা। অন্যান্য ফি ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৯৯৪ টাকা। আর মূসক আদায় হয়েছে ২ কোটি ৩৭ লাখ ৩৩ হাজার ৯১টাকা।

এছাড়া উৎসে কর (৫৩ এইচ) ৪০ কোটি ২৭ লাখ ৮৪ হাজার ৭৯৯ টাকা। উৎসে আয়কর (৫৩ এইচ এইচ) ৭ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৪ টাকা। উৎসে আয়কর (৫৩ এফ এফ) ৩ কোটি ৭১ লাখ ৫ হাজার ২২৫ টাকা। দলিল, নকল, পে-অর্ডার, নগদ আদায় ও হলফনামার স্ট্যাম্প শুল্ক খাতে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৪ টাকা। স্থানীয় সরকার কর খাতে ১৬ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার ৮৪০ টাকা। এর বাইরে নকল আবেদন ও হস্তান্তর নোটিস ডিনোটেশনের আবেদন বাবদ ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৪০০ টাকাসহ মোট ৮৯ কোটি ৭ লাখ ১৫ হাজার ৪০১ টাকা রাজস্ব পেয়েছে সরকার।

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত