সুগন্ধা বিচের নাম বদলানোর প্রস্তাবে আলোচনা-সমালোচনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

  • সুগন্ধা বিচকে বঙ্গবন্ধু বিচ করার প্রস্তাব
  • অনুমোদন ছাড়া বঙ্গবন্ধুর নামে নামকরণের সুযোগ নেই

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সুগন্ধা বিচ ও সুগন্ধা থেকে কলাতলী পর্যন্ত অংশের নাম বদলের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে সুগন্ধা পয়েন্টকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম অনুসারে “বঙ্গবন্ধু বিচ” এবং সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে কলাতলীর মাঝামাঝি সৈকতকে “বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচ” নামে নামকরণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

গত সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সৈকতের দুটি পয়েন্টের নাম পরিবর্তন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই প্রস্তাব নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সমুদ্র সৈকতের বহু পুরনো নাম হঠাৎ করে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ।

বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সৈকতের দুটি পয়েন্টের নাম বদলানোর ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান। তবে এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কিছু সমস্যা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। ফলে তারা এখনো কোনো পদক্ষেপ নেননি।

জেলা প্রশাসক বলেছেন, “বঙ্গবন্ধুর নামে কোনো কিছু করতে গেলে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অ্যাপ্রুভাল লাগবে। আমরা যতদূর খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এই ক্ষেত্রে সেই অ্যাপ্রুভাল নেই। তাই আমরা কোনো ব্যবস্থা নিইনি।”

জানা গেছে, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মো. সোলায়মান মিয়া সৈকতের এই দুটি পয়েন্টের নাম পরিবর্তনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেন। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নামকরণের জন্য একাদশ জাতীয় সংসদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ১৩তম বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।

এ ব্যাপারে মো. সোলায়মান মিয়া বলেন, “যেহেতু কক্সবাজার দিন দিন মানুষের যাতায়াত বেড়ে যাচ্ছে। বিচ এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে এতো বিচ অথচ জাতির পিতার নামে একটা বিচ থাকবে না? সেই তাগিদ থেকেই আমরা এই বিষয়ে আবেদন করেছি।”

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ বলছে, তাদের আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করে তা সচিবের কাছে পাঠিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। মন্ত্রণালয় থেকে সেটি কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়।

তবে, গত বুধবার বিবিসি বাংলা যখন মন্ত্রীর সঙ্গে এই বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করে, তিনি বলেন, “সচিবের কাছ থেকে একটু আধটু শুনেছি, এ নিয়ে বিস্তারিত আমার জানা নেই।”

তাহলে মন্ত্রীর অগোচরে চিঠি কিভাবে গেল কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের কাছে? এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, “আমি এটা খেয়াল করিনি। এটা কী করে হয়? আমি এ বিষয়ে আগামীকাল কথা বলব।”

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামে “বঙ্গবন্ধু” যুক্ত করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমোদন নেওয়ার বিধান চালু হয় ২০১৯ সালে। তবে ট্রাস্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, সমুদ্র সৈকতের নাম বদলের কোনো প্রস্তাবের কথা তাদের জানা নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাদুঘরের কিউরেটর ও ট্রাস্টের বাছাই কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমার জানা মতে, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের পক্ষ থেকে এমন কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি।”

নাম পরিবর্তনের উদ্যোগে যেভাবে
গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ নামের একটি সংগঠন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠায়। সংগঠনের সভাপতি মো. সোলায়মান মিয়ার সই করা ওই চিঠিতে কক্সবাজারের সুগন্ধা সমুদ্র সৈকতের নাম “বঙ্গবন্ধু বিচ” এবং সুগন্ধা ও কলাতলী বিচের মাঝখানের জায়গাটিকে বীর “মুক্তিযোদ্ধা বিচ” নামকরণের দাবি জানানো হয়।

সেই চিঠিতে দেখা যায়, ওই দিনই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক তার সচিবকে মার্ক করে চিঠিতে সই করেন। এর দশ দিন পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠায় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অধিশাখার সহকারি সচিব মো. সাহেব উদ্দিনের সই করা ওই চিঠিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মো. সোলায়মান মিয়া কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের দুটি পয়েন্টের নাম পরিবর্তনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেছিলেন।

ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১৩তম বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মঙ্গলবার চিঠি পাঠানো হয় জেলা প্রশাসকের কাছে।

চিঠিতে বলা হয়, “স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সুগন্ধা বিচকে “বঙ্গবন্ধু বিচ” এবং সুগন্ধা ও কলাতলী বিচের মাঝখানের খালি জায়গার নাম হবে “বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচ”।

ওই চিঠির বিষয় কথা বলতে মন্ত্রণালয়ের সহকারি সচিব সাহেব উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে বুধবার এ নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক শাহীন ইমরান বলেন, “অনুমোদন ব্যতীত বঙ্গবন্ধুর নামে কোনো কিছু করা সুযোগ নেই। প্রোপার অথরিটি যারা তাদের অনুমোদন ছাড়া এটা ব্যবহার করা যাবে না।”

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়া
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠির পর বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়। এরপর শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।

এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই সমালোচনা করছেন। মো. জামালউদ্দিন নামে একজন ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “সুগন্ধা বিচ ‘বঙ্গবন্ধু বিচ’ নামে মেনে নিতে পারলাম না। ছোট্ট একটা বিচ কেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে হবে আমার প্রশ্ন।”

ইউটিউব ও ফেসবুকেও অনেককে ট্রল করে পোস্ট করতে দেখা যায়। বুধবার কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে অনেকে আবার ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলছেন, “বঙ্গবন্ধু বিচ ঘুরতে এলাম।”

কিছু ফেসবুক গ্রুপে নতুন নামকরণের বিষয়টি নিয়ে গ্রুপের সদস্যদের কাছ থেকে মতামতও জানতে চাওয়া হয়। সে সব মতামতে বেশিরভাগ ফেববুক ব্যবহারকারীদেরই এ নিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করতে দেখা গেছে।

যদিও কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের নাম পরিবর্তন হয়নি বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, “আমরা এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নিইনি। সুতরাং, আগে এ সমুদ্র সৈকতের নাম যেটি ছিল এখনও সেটিই আছে।”

তিনি বলেন, “মন্ত্রণালয় একটা প্রস্তাব দিলে তাৎক্ষণিকভাবে তো সেটা কার্যকর হওয়ার কিছু নেই। বিষয়গুলো আমাদের দেখতে হবে। এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কোনো অনুমোদন নেই।”

বঙ্গবন্ধু নামকরণ যেভাবে হয়
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম বঙ্গবন্ধুর নামে করার এক ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে বাংলাদেশে। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালের এপ্রিলে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, এই ধরনের কোনো কিছুর নামকরণ করার আগে তাতে বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের অনুমতি লাগবে।

তবে সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয় শুধু নাটক, সাহিত্যকর্ম ও ক্রীড়া অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আগে থেকে এ ধরনের অনুমতির প্রয়োজন হবে না। শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের নামে কোনো প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল জাদুঘরের কিউরেটর ও নাম বাছাই কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, “বঙ্গবন্ধুর নামে এমন কিছু করতে হলে আগে থেকেই ট্রাস্টের কাছে আবেদন করতে হয়।”

নিয়ম অনুযায়ী কেউ নামকরণের আবেদন করলে সেই আবেদন বাছাই করা হবে ট্রাস্টের সদস্য ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূরে আলম চৌধুরী লিটনের নেতৃত্বে।

যাচাই-বাছাই শেষে কমিটি প্রাথমিকভাবে অনুমোদন দিলে পরবর্তীতে সেটি ট্রাস্টের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পরই নামকরণ হতে পারে বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারের কারো নামে।

নজরুল ইসলাম খান আরও বলেন, “কক্সবাজারের একটি সমুদ্র সৈকতের নাম বঙ্গবন্ধুর নামে করার বিষয়ে কিছু খবর পত্রিকায় দেখেছি। তবে আমার জানা মতে, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো আবেদন করা হয়নি, কিংবা এমন কোনো অনুমোদনও ট্রাস্ট দেয়নি।”

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত