- প্রতিদিন জন্ম নেয় প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শিশু
- জন্মহার বেশি জনসংখ্যা স্থির
- গত মার্চ পর্যন্ত জাতিসংঘের নিবন্ধিত সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ
- দুই বছর আগে সরকারি দপ্তর জানায় ১২ লাখ
- টেকনাফ ও উখিয়ায় বাংলাদেশি জনসংখ্যা প্রায় ৬ লাখ
মিয়ানমারে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের প্রায় পাঁচ দশক চলছে। বর্তমান হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১০০ শিশুর জন্ম হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রকৃত সংখ্যা কত, হিসাবের গরমিলে তা জানা সম্ভব হচ্ছে না। দুই বছর আগে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত। তবে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সর্বশেষ হিসাব বলছে, নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। তাহলে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কি বাড়ে না, এমন প্রশ্ন উঠেছে।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্টের শেষের দিকে রোহিঙ্গা ঢল নামে। সব মিলিয়ে সেই সময় থেকে বলা হচ্ছে দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখের কাছাকাছি। আসলে রোহিঙ্গার সংখ্যা কত তার পূর্ণাঙ্গ ডেটা সরকারের কাছে নেই। যদিও জাতিসংঘ একটি ডেটাবেজ তৈরি করেছে তাও অপূর্ণাঙ্গ।
কক্সবাজারের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও স্থানীয়দের দাবি, ৫০ বছরে দেশে বিভিন্ন সময়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১৬-১৭ লাখ ছাড়িয়েছে। সঠিক সংখ্যা সরকারের কাছে না থাকার কারণে রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের সঙ্গে আত্মীয়তায় জড়িয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের সংখ্যা ২৮ লাখ ৭৪ হাজার। এর মধ্যে যেখানে রোহিঙ্গরা আশ্রিত সেই দুই উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়ায় বাংলাদেশিদের সংখ্যা ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৯০০।
কক্সবাজারের সুশীল সমাজের নেতারা বলছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হলে আগামী ১১-১২ বছরের মধ্যে রোহিঙ্গা ও জেলার স্থানীয় বাসিন্দা সমান সমান হয়ে যাবে। তাতে পর্যটন জেলার নিরাপত্তা আরও বেশি হুমকিতে পড়বে।
টেকনাফ ও উখিয়ায় ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যক শরণার্থী। বাকিরা আশ্রিত বা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা।
জানা গেছে, ১৯৭১ সাল থেকে দুই-একটি পরিবার বাংলাদেশে এলেও ১৯৭৮ সালে ২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসে। এরপর ১৯৯১ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের সময় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। ওই দুই দফায় আসা রোহিঙ্গাদের একটা অংশ মিয়ানমারে ফিরে যায়। তবে অর্ধেকের বেশি ফেরেনি।
এরপর ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা ঢল শুরু হয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে আরও প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আগের সাড়ে ৪ লাখসহ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে দেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ।
ইউএনএইচসিআরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭২ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল। ওই বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৩।
রোহিঙ্গা রিফিউজি রেসপন্স নামের একটি সংগঠন বলছে, বাংলাদেশে ১৯৭৮, ৯২, ২০১২ ও ২০১৬ সালেও কিছু রোঙ্গিার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। ২০১৬ সালে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে অন্তত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছিল বাংলাদেশে।
আর আগে থেকে বাংলাদেশে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত মিলিয়ে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতি ছিল। যদিও এই হিসাব নিয়ে প্রশ্ন আছে।
ইউএনএইচসিআরের চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত হিসাবে বাংলাদেশে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৭৮ হাজার ৩। এর মধ্যে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলোয় আছে ৯ লাখ ৪২ হাজার ৯৪৪ জন আর নোয়াখালীর ভাসানচরে আছে ৩৫ হাজার ৫৯ জন।
২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনএইচসিআরের যৌথ নিবন্ধন কার্যক্রমে নিবন্ধিত হয়েছে ৯ লাখ ৪৫ হাজার ৯৫৩ জন।
ওই বছর আগস্ট মাসে রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করছে। এই হিসাবে ৪ বছরে রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
এর আগে ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশে এখন ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে সাম্প্রতিক জনসংখ্যার উপচেপড়া ভিড় তার পরিকাঠামোয় চাপ সৃষ্টি করেছে।
রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক ও পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের একটি পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ তৈরি করা জরুরি। এই ডেটাবেজ থাকলে রোহিঙ্গাদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া, ভোটার হওয়া, বাংলাদেশের নাগরিক সনদ নেওয়া, পালিয়ে বিদেশ যাওয়া এগুলো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে। তারা মনে করেন, ২০১৭ সালের আগস্টে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এসেছিল। সেখানে অনেক কিশোর-কিশোরী ছিল। তারা এরই মধ্যে বিয়ে-শাদি করেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ও বিভিন্ন সংস্থা বলছে, প্রতিবছর অন্তত ৩০ হাজার রোহিঙ্গ শিশু জন্ম নিচ্ছে। সেই হিসাবে গত সাড়ে ৬ বছরে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গার তালিকায় যুক্ত হওয়ার কথা। এ ছাড়া ১৯৭৮ সাল থেকে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকা যে ৪ লাখের কথা বলা হচ্ছে তা-ও আর বাড়ছে না।
স্থানীয়রা বিভিন্ন সময়ে বলে আসছে, রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ১৬ থেকে সাড়ে ১৬ লাখ হবে পর্যবেক্ষকরা এর সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তাদের অভিমত, রোহিঙ্গাদের জন্মহার অনেক বেশি।
রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, ‘আমিও মনে করি ৫ দশকে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। স্থানীয়রা যে বলছেন ১৬-১৭ লাখ, সেটা তারা অনুমান করে বললেও সংখ্যাটা কম হবে না। সংখ্যা আরও কম হলেও ডেটাবেজ থাকা দরকার সরকারের কাছে।’ তিনি বলেন, ২০১৭ সালের শেষের দিকে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ। তাতেও বড় একটা ডেটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। এখন সেটা ধরে আপডেট করতে হবে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে সংখ্যাটা তুলে ধরাও একটা বড় বিষয়।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ইউএনএইচসিআরের কাছে রক্ষিত রোহিঙ্গা ডেটাবেজ ব্যবহার করতে চাইছে সরকার। এ বিষয়ে সহায়তার জন্য জাতিসংঘের ওই সংস্থা প্রাথমিক সম্মতিও দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ডেটাবজ করতে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ডেটাবেজ তৈরি হলে রোহিঙ্গাদের পক্ষে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশের ডিপার্টমেন্ট অব ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্ট ও ইউএনএইচসিআর যৌথভাবে রোহিঙ্গা ডেটাবেজ তৈরির একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। সেই সময় প্রায় ৭ লাখের মতো রোহিঙ্গার ডেটাবেজ তৈরির পরে সেটা ইউএনএইচসিআরের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সংস্থাটি এখন ডেটাবেজ আপডেটের কাজ করছে। প্রায় ৯ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গার ১০ হাতের আঙুলের ছাপ ও চোখের রেটিনার স্ক্যান করা আছে জাতিসংঘ সংস্থাটির কাছে। ওই ডেটাবেজটি জেনেভায় একটি সার্ভারে রক্ষিত আছে।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, রোহিঙ্গাদের পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেজ তৈরি করে প্রত্যাবাসন শুরু করতে হবে।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, ‘প্রত্যাবাসনই বড় সমাধান। এখন সব থেকে জরুরি রোহিঙ্গাদের জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করা। তাদের সংখ্যা এখন কত তা আমাদের সরকারের কাছে থাকতে হবে। যেভাবে রোহিঙ্গা বাড়ছে আর কয়েক বছরের মধ্যে আমরাই সংখ্যালঘু হয়ে যাব।’