বাংলাদেশে ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় কক্সবাজারে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তখন আশ্বাস দিয়েছিল তাদের ভরণ করবে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এ শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে গিয়ে কক্সবাজারের যে স্থানীয় পরিবেশ, অবকাঠামো ও অন্য ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে। এ ঋণের অর্থ ২ শতাংশ হারে সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। সব মিলিয়ে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৭০ কোটি ডলারের ঋণ ও অনুদান নিচ্ছে সরকার।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের উন্নয়ন ও ওই অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্দেশ্যে দুটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক)। গতকাল মঙ্গলবার একনেক চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভায় প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার এ দুটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়।
গতকালের একনেক সভায় প্রায় ১৪ হাজার ৩৩৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয় সংবলিত ১১টি প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৬ হাজার ৫৪১ কোটি ৫২ লাখ টাকা, বিদেশি অর্থায়ন ৭ হাজার ৮৭৯ কোটি ১৫ লাখ এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন কমেছে ৮৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে ‘হোস্ট এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক (এফডিএমএন)/বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনসংখ্যা (ডিআরপি) মাল্টি-সেক্টরাল অ্যাপ্রোচ প্রজেক্টের (হেল্প) মাধ্যমে জীবন বৃদ্ধি করা’ অবকাঠামো সম্পর্কিত প্রকল্প। এ প্রকল্পটিতে ব্যয় হবে ৪ হাজার ৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ^ব্যাংকের ঋণ ২ হাজার ৩৩০ কোটি, একই সংস্থার অনুদান ১ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। বাকি ২৬৬ কোটি টাকা সরকারের ও মন্ত্রণালয়গুলোর নিজস্ব।
এ প্রকল্পটি একটি গুচ্ছ প্রকল্প বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সচিব ড. এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। তিনি জানান, এটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ ছয়টি বিভাগের সমন্বয়কারী বিভাগ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের গুচ্ছ প্রকল্প।
এ ছাড়া দ্বিতীয় আরেকটি প্রকল্প ‘হোস্ট সম্প্রদায় এবং এফডিএমএন জনসংখ্যা প্রকল্পের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিষেবা’ শীর্ষক প্রকল্পটির বাস্তবায়নও ছয়টি সংস্থা করবে। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। এতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ২ হাজার ১৪৫ কোটি, একই সংস্থার অনুদান ১ হাজার ৭৫৯ কোটি, সরকারের অর্থায়ন ৪৯৬ কোটি টাকা।
সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সত্যজিৎ কর্মকার সাংবাদিকদের জানান, মিয়ানমারের ক্ষতিগ্রস্ত ও স্থানীয়দের জন্য নেওয়া প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক এক বছরের জন্য অনুদান দেবে। তাছাড়া কিছু ঋণও দেওয়া হবে। শুরুতে বিশ্বব্যাংক ও দাতারা শুধু রোহিঙ্গাদের জন্য দিতে চেয়েছিল, পরে আলাপ করে সেখানকার ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যও চাওয়া হলে তা দিতে রাজি হয়েছে। এসব টাকায় যোগাযোগ তথা রাস্তা, রেলপথ নির্মাণ করা হবে। তিনি বলেন, ‘যে বন ও পাহাড় নষ্ট হয়েছে তা উন্নয়ন করা হবে। এসব বাস্তবায়ন করতে তিন-চার বছর সময় লাগবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে বনাঞ্চল নষ্ট হয়েছে, তা উন্নয়নে কাজ করা হবে।’
সচিব জানান, বিশ্ব সাহায্য সংস্থাগুলো কথা দিয়েছিল তারা শুধু রোহিঙ্গাদের অর্থায়ন করবে। পাশের জেলাগুলোর মানুষের ভৌত উন্নয়নে সার্বিকভাবে করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তাকে দুই ভাগে ব্যয়ের জন্য ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয় লোকজনের জন্য ব্যয় হবে ৩৫ কোটি ডলার। এ অর্থ রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, বনায়ন, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ খাতে ব্যয় করা হবে। এজন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় আলাদা করে ছয়টি প্রকল্প নিয়েছে।
দ্বিতীয় ভাগের ৩৫ কোটি ডলার ব্যয় হবে রোহিঙ্গাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে। এর মধ্যে ১৯ কোটি ডলার ঋণ। বাকি ১৬ কোটি ডলার অনুদান। এ অর্থে রোহিঙ্গা শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সপ্তাহের পাঁচ দিন খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে করা হবে ডায়াগনস্টিক সেন্টার। দেওয়া হবে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা। জন্মনিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে ছয়টি প্রকল্প নিয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়।
সত্যজিৎ কর্মকার জানান, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন এরপর রোহিঙ্গাদের জন্য ঋণ করে আর কোনো প্রকল্প নেওয়া যাবে না।
২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা এ দেশে আসার পর এটি হবে কোনো উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে বাংলাদেশের বড় আকারের ঋণ নেওয়ার ঘটনা। এতদিন সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা হিসেবে শুধু বিদেশি অনুদান গ্রহণ করেছে। যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনার (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান) আওতায় প্রায় সাত বছর ধরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে জাতিসংঘ।
জানা গেছে, এই ৭০ কোটি ডলার ঋণ ও অনুদান দিতে সরাসরি ইআরডি বা পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ না করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে তাড়াহুাড়া করে প্রকল্পগুলো অনুমোদন করা হচ্ছে। এ অনুদান ও ঋণ ব্যয়ের জন্য নেওয়া প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রকল্পে পরামর্শকের জন্য অস্বাভাবিক খরচের প্রস্তাব করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকল্পের বিস্তারিত সমীক্ষা করা হয়নি।