সিলেটে রোমাঞ্চের ঢেউ জাগানো ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অসাধারণ এক জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েও অল্পের জন্য পারল না বাংলাদেশ।
একজন টি-টোয়েন্টি দলে ফিরেছেন দেড় বছর পর। আরেকজন তো দলেই ছিলেন না শুরুতে। নানা বিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত সুযোগ পেয়েছেন দলে। সেই দুজন মিলেই জমিয়ে দিয়েছিলেন ম্যাচ। মাহমুদউল্লাহর পাল্টা আক্রমণ ও জাকের আলির বীরোচিত ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ জাগিয়েছিল পাহাড় টপকে স্মরণীয় এক জয়ের সম্ভাবনা। তবে শেষ পর্যন্ত দুর্দান্ত এক শেষ ওভারে শ্রীলঙ্কাকে জেতালেন দাসুন শানাকা।
রোমাঞ্চের ঢেউ জাগানো প্রথম টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশকে তিন রানে হারিয়ে তিন ম্যাচের সিরিজে এগিয়ে গেল শ্রীলঙ্কা।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সোমবার ২০৭ রান তাড়ায় বাংলাদেশ পাওয়ার প্লেতেই হারায় ৩ উইকেট। কিন্তু সেখান থেকেই ঝড়ো ফিফটিতে দলকে লড়াইয়ে ফেরান দীর্ঘদিন পর দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টি খেলতে নামা মাহমুদউল্লাহ। তার বিদায়ের পর পাওয়ার ব্যাটিংয়ের অসাধারণ প্রদর্শনীতে দলকে অভাবনীয় এক জয়ের স্বপ্ন দেখান জাকের। ছক্কার রেকর্ড গড়ে দলকে জয়ের কাছে নিয়ে যান জাতীয় দলের হয়ে প্রথম খেলতে নামা ব্যাটসম্যান।
শেষ ওভারে বাংলাদেশের প্রয়োজন পড়ে ১২ রানের। বল হাতে আক্রমণে আসেন শানাকা।
তার প্রথম বলটি ফুল টস পেয়েও আউট হয়ে যান রিশাদ হোসেন। তৃতীয় বলে ছক্কার চেষ্টায় সীমানায় ধরা পড়েন জাকের। বাংলাদেশের আশার সমাপ্তি বলা যায় সেখানেই। শরিফুল ইসলাম গিয়ে প্রথম বলে চার মারেন বটে। তবে শেষ দুই বলে স্নায়ুর চাপ সামলে শ্রীলঙ্কাকে জেতান শানাকা।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ফেরার ম্যাচে ৩১ বলে ৫৪ করেন মাহমুদউল্লাহ। জাকেরের ব্যাট থেকে আসে ৩৪ বলে ৬৮ রান। ৬টি ছক্কা মারেন ২৬ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। এই সংস্করণে এক ইনিংসে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের যা সর্বোচ্চ।
এই সিরিজের জন্য প্রথম ঘোষিত দলে তিনি ছিলেন না। তবে বিপিএল পাওয়ার হিট দেখিয়ে নজর কাড়া এই ব্যাটসম্যানকে দলে না নেওয়ায় কড়া সমালোচনা করেন তার বিপিএল দল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। পরে স্পিনার আলিস ইসলাম চোটের কারণে ছিটকে পড়ায় নেওয়া হয় জাকেরকে। প্রথম সুযোগেই তিনি দেখিয়ে দিলেন নিজের সামর্থ্য।
গত বছর এশিয়ান গেমস ক্রিকেট দিয়ে তার আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়ে যায়। যদিও সেটি আসলে জাতীয় দল ছিল না। এবার বিপিএলে নিজেকে নতুন করে চেনানোর পর জাতীয় দলে প্রথম সুযোগেই খেললেন স্মরণীয় এক ইনিংস। স্রেফ দলকে জেতাতে পারলেন না একটুর জন্য।
ম্যাচের শুরুতে টস হেরে আগে ব্যাটিং পেয়ে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক চারিথ আসালাঙ্কা বলেছিলেন, ১৭০ রানের আশেপাশে স্কোরকে যথেষ্ট মনে করেন তিনি। পরে প্রমাণ হয়ে যায়, ওই রান মোটেও পর্যাপ্ত নয়। রানটা যে এত বেশি হলো, সেটিতে বড় অবদান আসালাঙ্কারই।
কুসাল মেন্ডিস ও সাদিরা সামারাউইক্রামার ফিফটিতে বড় স্কোরের ভিত পায় শ্রীলঙ্কা। পরে আসালাঙ্কার ছয় ছক্কার ক্যামিও ইনিংস দলকে পার করায় দুইশ।
ম্যাচের শুরুটা ছিল বাংলাদেশের জন্য আশা জাগানিয়া। শরিফুল ইসলামের করা ম্যাচের প্রথম বলেই আভিশকা ফার্নান্দো বাউন্ডারি পান ব্যাটের কানায় লেগে। বিপজ্জনক এই ওপেনার পরের বলেই ক্যাচ দেন উইকেটের পেছনে।
নতুন ব্যাটসম্যান কামিন্দু মেন্ডিস প্রথম বলেই আউট থেকে বেঁচে যান অল্পের জন্য।
সবুজ উইকেটে বেশ মুভমেন্ট আদায় করে নিচ্ছিলেন শরিফুল ও তাসকিন আহমেদ। বাউন্সও ছিল ভালো। তবে সেই লাইন-লেংথ ধরে রাখতে পারেননি তারা। সেটির ফায়দা নেয় লঙ্কানরা।
লেগ স্টাম্পে বল পেয়ে শরিফুলকে ছক্কায় ওড়ানোর পর ওই ওভারের স্টাম্পের বাইরের বলে চার মারেন কামিন্দু। পরের ওভারে শেখ মেহেদি হাসানের ফুল টস উড়িয়ে মারেন তিনি গ্যালারিতে।
আরেকপাশে কুসাল মেন্ডিসের ব্যাট থেকেও আসে দুটি বাউন্ডারি। রান বাড়তে থাকে তরতরিয়ে।
তাসকিন প্রান্ত বদলে আক্রমণে ফিরে ভাঙেন এই জুটি। শর্ট বলে পুল করে শর্ট মিড উইকেটে ধরা পড়েন কামিন্দু (১৪ বলে ১৯)।
এরপর কুসাল ও সামারাউইক্রামার সেই জুটি। আবারও মেহেদির এক ওভারে ছক্কা-চার মারেন দুজন। রিশাদ হোসেন আক্রমণে এসে অবশ্য এক প্রান্তে একটু সামাল দেন রানের গতি। তবে প্রান্ত বদলে তিনি অন্য দিক থেকে বোলিংয়ে আসার পর তার ওপর চড়াও হন কুসাল। ফিফটি স্পর্শ করেন তিনি ২৮ বলে। পরের ওভারে শরিফুলকে তুলাধুনা করেন সামারাবিক্রমা।
১১ ওভারে শ্রীলঙ্কার রান ছিল ৮৪। পরের দুই ওভারে আসে ৩৯ রান। রিশাদের ওভার থেকে ১৮, শরিফুলের ওভারে ২১।
রিশাদ আবার আগের প্রান্তে ফিরে এই জুটি ভাঙেন। ছক্কার চেষ্টায় সীমানায় ধরা পড়েন কুসাল।
শ্রীলঙ্কার রানের গতিও কিছুটা কমে আসে ওই সময়। তিন ওভারে রান ওঠে ১৯।
তবে শেষদিকে অনুমিতভাবেই তান্ডব চালায় লঙ্কানরা। শেষ চার ওভারে ছক্কার মালা গেঁথে ঝড়ের বেগে রান বাড়ান আসালাঙ্কা। তাসকিনকে দুটি ছক্কা মারেন তিনি, শরিফুলকে একটি আর মুস্তাফিজকে তিনটি।
মুস্তাফিজের করা শেষ ওভার থেকে রান আসে ২৪। শেষ চার ওভারে শ্রীলঙ্কা তোলে ৬৪ রান।
আসালাঙ্কা ও সামারাউইক্রামার অবিচ্ছিন্ন জুটির রান ৩৩ বলে ৭৩।
৬ ছক্কায় ২১ বলে ৪৪ রানে অপরাজিত থাকেন আসালাঙ্কা। পঞ্চাশ না ছোঁয়া ইনিংসে কোনো লঙ্কান ব্যাটসম্যানের সবচেয়ে বেশি ছক্কা এটিই।
একসময় ২৭ বলে ২৫ রানে থাকা সামারাউইক্রামা পরের ২১ বলে করেন ৩৬ রান।
বিশাল রান তাড়ায় প্রয়োজন ছিল উড়ন্ত শুরু। বাংলাদেশের শুরুটা হয় উল্টো। লিটন কুমার দাস বাজে শটে বিদায় নেন শূন্যতেই। ইনিংসের প্রথম দুই বলে রান না পেয়ে তৃতীয় বলে শাফল করে অফ স্টাম্পের বাইরের বল লেগ সাইডে খেলার চেষ্টা করেন অভিজ্ঞ ওপেনার। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের সেই ১১৮ কিলোমিটার গতির মিডিয়াম পেসেই তিনি ক্যাচ দেন উইকেটের পেছনে।
বিনুরা ফার্নান্দোর বলে ব্যাটের কানায় লেগে বাউন্ডারিতে শুরু করেছিলেন সৌম্য সরকার। কিন্তু ওপেনিংয়ের সুযোগটা হেলায় হারান তিনি ওই বাঁহাতি পেসারকেই উড়িয়ে মারার চেষ্টায় (১১ বলে ১২)।
তাওহিদ হৃদয় প্রথম বলেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে চোখধাঁধানো এক ছক্কা মারেন বিনুরাকে। কিন্তু প্রতিটি বলই অন সাইডে খেলার চেষ্টা করছিলেন তিনি। খেসারতও দেন দ্রুতই। ম্যাথিউসকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে মারার চেষ্টায় ৮ রানেই থামে তার ইনিংস।
এরপর মাহমুদউল্লাহও শুরু করেন প্রথম বলে দুর্দান্ত শটে ছক্কা দিয়ে। হৃদয়ের মতো দ্রুতই থেমে যাননি তিনি। আরেক পাশে শান্ত অবশ্য টাইমিং করতেই পারছিলেন না। উইকেটে তার অস্বস্তিময় উপস্থিতি শেষ হয় মাথিশা পাথিরানার শর্ট বলে।
২০ রান করতে ২২ বল খেলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। নবম ওভারে বাংলাদেশের রান তখন ৪ উইকেটে ৬৮। লক্ষ্য তখন অনেকটা দৃষ্টিসীমার বাইরে।
কিন্তু মাহমুদউল্লাহ বিশ্বাসটা রেখে পাল্টা আক্রমণের পালা চালিয়ে যান। দাসুন শানাকাকে ছক্কা মারার পর পাথিরানার ফ্রি হিটে বল আছড়ে ফেলেন তিনি স্টেডিয়ামের গ্যালারির ছাদে! ওই ওভারে দারুণ এক র্যাম্প শটে ছক্কা মারেন জাকের আলিও।
তিনটি ওয়াইড ও দুটি নো বলসহ পাথিরানার ওই ওভার থেকে আসে ২২ রান।
দ্বিতীয় স্পেলে ফেরা বিনুরাকেও একটি ছক্কা মারার পর মাহমুদউল্লাহ ফিফটিতে পা রাখেন ২৭ বলে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে যৌথভাবে তার দ্রুততম ফিফটি এটি। নিজের সবশেষ ফিফটিতেও ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাপুয়া নিউ গিনির বিপক্ষে তার পঞ্চাশ এসেছিল ২৭ বলে।
তাকে থামাতে মাহিশ থিকশানাকে আক্রমণে ফেরান লঙ্কান অধিনায়ক। কাজ হয় এতে। ছক্কার চেষ্টায় সীমানায় ধরা পড়েন মাহমুদউল্লাহ।
বাংলাদেশের আশার শেষ দেখা তখন অস্বাভাবিক নয়। তবে জাকের আলির মনে ছিল অন্য ভাবনা।
মাহমুদউল্লাহর বিদায়ের পর তিনি বুঝে যান, যা করার তাকেই করতে হবে। ওই ওভারেই ছক্কা মারেন তিনি থিকশানাকে, পরের ওভারে শানাকাকে দুটি।
শিশির ভেজা বল তখন গ্রিপ করতে ধুঁকছিলেন লঙ্কান বোলাররা। জাকের তা কাজে লাগান দুর্দান্ত সব শটের প্রদর্শনীতে। শেখ মেহেদি হাসানের সঙ্গে তার জুটিতে ৬৫ রান আসে কেবল ২৭ বলেই!
তাতে জাকেরের অবদান ১৬ বলে ৪৩। মেহেদি বিদায় নেন ১১ বলে ১৬ করে।
জাকের তবু হাল ছাড়েননি। ১৯তম ওভারে পাথিরানাকে তিনটি চার মেরে আশা উজ্জ্বল করেন আরও। কিন্তু শেষ ওভারে পেরে ওঠেননি তিনি, পারেনি বাংলাদেশ।
তিন সংস্করণের নিয়মিত অধিনায়ক হিসেবে শান্তর যাত্রা শুরু হলো নাটকীয় ম্যাচ দিয়ে।
সিরিজের পরের ম্যাচ একই মাঠে বুধবার।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
শ্রীলঙ্কা: ২০ ওভারে ২০৬/৩ (আভিশকা ৪, কুসাল মেন্ডিস ৫৯, কামিন্দু মেন্ডিস ১৯, সামারাউইক্রামা ৬১*, আসালাঙ্কা ৪৪*; শরিফুল ৪-০-৪৭-১, তাসকিন ৪-০-৪০-১, শেখ মেহেদি ৩-০-৩০-০, মুস্তাফিজ ৪-০-৪২-০, রিশাদ ৪-০-৩২-১, সৌম্য ১-০-৮-০)।
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ২০৩/৮ (লিটন ০, সৌম্য ১২, শান্ত ২০, হৃদয় ৮, মাহমুদউল্লাহ ৫৪, জাকের ৬৮, মেহেদি ১৬, রিশাদ ০, তাসকিন ২*, শরিফুল ৪*; ম্যাথিউস ৩-০-১৭-২, বিনুরা ৪-০-৪১-২, থিকশানা ৪-০-৩২-১, শানাকা ৩-০-৩৬-২, দানাঞ্জায়া ২-০-১৯-০, পাথিরানা ৪-০-৫৬-১)।
ফল: শ্রীলঙ্কা ৩ রানে জয়ী।
সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে শ্রীলঙ্কা ১-০তে এগিয়ে।
ম্যান অব দা ম্যাচ: চারিথ আসালাঙ্কা।