মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ

রায়হান আহমেদ তপাদার

গাজা যুদ্ধে আন্তর্জাতিক যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, সেটা বিশ্বরাজনীতির গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী একটি প্রবণতার প্রতিফলন। এটা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আইনের শাসনভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থায় ফাটল। চীনের প্রভাব এবং ইউক্রেন যুদ্ধের বিপর্যয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক ব্যাখ্যা করছেন, বহুমেরু কেন্দ্রিক একটি বিশ্বের জন্ম হচ্ছে। গতবছরের পুরোটা সময়জুড়ে মধ্যপ্রাচ্যে কিছু বড় রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছে।

সৌদি-ইরান চুক্তি হয়েছে। আসাদের নেতৃত্বাধীন সিরিয়ার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘটনার মতো ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্ব নিরসনের এবং এই অঞ্চলের পারস্পরিক সম্পর্ক পুনর্র্নিমাণের সম্ভাবনাকে বাড়াচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান সংঘাত ও মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয়ের কারণে এ বছর মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি অশান্ত ও ঘটনাবহুল বছর ছিল। ২০২৩ সালের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আলোচনার সময় মধ্যপ্রাচ্যের জন্য পরবর্তী বছর কী বয়ে আনতে পারে, তা বিবেচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গত এপ্রিলে সুদানে বেজে ওঠা যুদ্ধের ডামাডোল আর অক্টোবর থেকে অদ্যাবধি গাজায় ইসরায়েলের চালানো বর্বর অভিযানের সাক্ষী হয়ে থাকছে ২০২৩ সাল। এছাড়া প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগও আমাদের ঝাঁকুনি দিয়েছে। বিশেষত লিবিয়ার দেরনা বাঁধ ভেঙে যাওয়া এবং তুরস্ক, সিরিয়া ও মরক্কোয় ভূমিকম্পের আঘাতে ৫৩ হাজার মানুষের প্রাণহানি সবাইকে হতবিহ্বল করেছে। এই প্রধান বিপর্যয়কর ঘটনাগুলোর কোনোটির কথাই আগেভাগে কারও পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না। তারপরও এই ঘটনাগুলো এই অঞ্চলের ভবিষ্যতের পথযাত্রাকে নির্দেশ করছে। মনে করা হচ্ছে, ২০২৪ সাল মধ্যপ্রাচ্যের যাত্রাকে উল্লেখযোগ্য ভাবে নতুন আদল দিতে পারে।

গাজায় ইসরায়েলের চলমান অভিযানের কারণে ২০২৪ সালের শুরুর দিকেই মধ্যপ্রাচ্য নিজেকে ঢেলে সাজানোর কাজে মন দিতে পারে। গত বছর ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছেন, গাজায় ইসরায়েলের অভিযান আরও কয়েক মাস প্রলম্বিত হতে পারে। তার মানে গাজা আরও চুরমার হতে বাকি আছে। এমনকি যদি গাজা ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি অস্ত্রবিরতি হয়ও, তাহলেও গাজার নিরাপত্তা ও প্রশাসন ইস্যু অমীমাংসিত থেকে যাবে এবং এটি ওই অঞ্চলের প্রধান ইস্যু হয়ে ঝুলে থাকবে। বিশেষ করে গাজার অবকাঠামো পুনর্গঠন ইস্যুতে আরব দেশগুলো এবং পশ্চিমা দাতাদেশগুলোর মধ্যে এই নিয়ে মতভিন্নতা তৈরি হতে পারে। পশ্চিমা দাতারা এর আগে গাজার অবকাঠামো পুনর্গঠনে বেশ কয়েক দফা সহায়তা দিয়েছিল। তারা অবশ্যম্ভাবীভাবে আরও একবার গাজায় অর্থ ঢালবে কি না, তা নিয়ে বড় দ্বিধায় পড়বে। ইসরায়েলের বর্বর হামলা সব ধরনের মানবিক বোধকে পদদলিত করেছে। এটি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের তরুণ প্রজন্ম সাংঘাতিক ক্ষুব্ধ হয়েছে। যথার্থ প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় আরব দেশগুলোর প্রতি তারা যে ক্রুদ্ধ, তা নিয়ে চলতি বছরের দোহা ফোরামে আলোচিত হয়েছে। এই তরুণদের ক্ষোভকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এই ক্ষুব্ধ তরুণেরা গোটা অঞ্চলের সামাজিক-রাজনৈতিক চিত্র আমূল বদলে দিতে পারে। ফলে আরব দেশগুলোকে বাধ্য হয়েই তাদের ইসরায়েল নীতিকে ঢেলে সাজানোর কথা ভাবতে হতে পারে। বিশেষ করে মিসর ও জর্ডানের মতো যেসব দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার আছে, সেসব দেশের সরকার জনতুষ্টিবাদের কারণেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিরোধিতা শুরু করতে পারে। এবং ২০২৩ সালে মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে জাতিসংঘ চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে এখানে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

সবারই কম বেশি জানা, ভূমিকম্পে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মানবিক বিপর্যয় ঘটার পর জাতিসংঘ যেভাবে যথার্থ প্রতিক্রিয়া দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, গাজায় তার ঠিক একই ভূমিকা দেখা গেছে। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে নিজেদের সমস্যা সমাধানে নিজেদের একটি সংস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা দিনকে দিন বাড়ছে। তাছাড়া গাজা যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব ২০২৪ সালে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মেনা অঞ্চলে পড়তে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ইতিমধ্যেই মেনা অঞ্চলকে অর্থনৈতিক অবনমনের পথে থাকা এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইয়েমেন, সিরিয়া ও সুদানে চলমান সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে। নিজেদের আঞ্চলিক সমস্যা নিজেদের সমাধান করতে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের নিজেদের তেলনির্ভরতা কমাতে হবে। এ বিষয়ে তারা ইতিমধ্যে সক্রিয় হয়েছে। তাদের যৌথ উদ্যোগ অতি দ্রুত মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নতুন মানচিত্র তৈরি করতে সক্ষম হবে। গাজা যুদ্ধ শেষে মধ্যপ্রাচ্য দেখতে কেমন হবে, তা নিয়ে আগে থেকে পুরোপুরিভাবে অনুমান করা সম্ভব নয়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু অবশ্য এ সংঘাতের মধ্য দিয়ে নতুন মধ্যপ্রাচ্যের জন্ম দেখতে পাচ্ছেন। গাজা যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল কী হতে যাচ্ছে, সেটা আমরা এখনো জানি না। এ যুদ্ধে একপক্ষীয় মহাবিপর্যয়ের তথ্যপ্রমাণ বেড়েই চলেছে। এ পর্যন্ত ২২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। গাজার বাড়িঘর ও অবকাঠামো ধ্বংস হওয়ায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত। মধ্যপ্রাচ্যের ‘নতুন চেহারা’কে আমরা বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তু ও শরণার্থীর স্রোত হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। এটি ১৯৪৮ সালের মতো করে নাকবা সৃষ্টির চেষ্টা, সেই ঘটনায় বাস্তুচ্যুতদের উত্তরসূরিরা এখন গাজার শরণার্থী শিবির গুলোতে বাস করে। তারা এখন আবার আরেকটি গণবাস্তুচ্যুতির মুখোমুখি।

গাজার এ পরিস্থিতি সিরিয়া যুদ্ধের সঙ্গে তুলনীয়। সিরিয়া যুদ্ধের কারণে, জনাকীর্ণ শরণার্থীশিবির ও অমানবিক পরিবেশে বিপুলসংখ্যক বাস্তুচ্যুত মানুষ বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এখন বাস্তুচ্যুত মানুষের নতুন প্রজন্মের জন্ম হচ্ছে। জর্ডানের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, জর্ডানিদের তুলনায় সিরিয়ান শরণার্থীদের জন্মহার বেশি। তুরস্ক, লেবানন, জর্ডান, ইরাক ও মিসরে নিবন্ধন করা সিরীয় শরণার্থীর সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি। সিরিয়ার ভেতরেও অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা লাখ লাখ। তাঁদের অধিকাংশকে বিরুদ্ধ পরিবেশ ও চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করতে হচ্ছে। ইয়েমেন যুদ্ধও মধ্যপ্রাচ্যে শরণার্থী সংকট উসকে দিয়েছে। এ যুদ্ধে ৪৫ লাখ মানুষ তাঁদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের কারণে গত দুই দশকে শরণার্থীর স্রোত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নিতে হয়েছে। এ তালিকায় এখন গাজার বাস্তুচ্যুত মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। এ যুদ্ধে একেকটা পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য মারা যাওয়ায় মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মও তৈরি করবে।ঘরবাড়ি-বসতি থেকে উচ্ছেদের এই বাস্তবতা চরমপন্থা, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা ও আক্রোশের জন্ম দেবে। এই বাস্তবতা অসন্তুষ্ট তরুণদের ইসলামিক স্টেটের মতো চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোতে যুক্ত হওয়ার প্ররোচনা জোগাবে। ২০২৩ সালটি বৈশ্বিক দক্ষিণের উত্থানের বার্তা আরও স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে। এর মধ্যে কিছু কাঠামোগত উদ্যোগ আমরা দেখেছি। আগস্ট মাসে জোহানেসবার্গে যে ব্রিকস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, সেখানে বৈশ্বিক দক্ষিণের ২১টি দেশ সদস্য হওয়ার আবেদন করে। আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত-এই ছয় দেশকে সদস্য করা হয়। ব্রিকস এখন ব্রিকসপ্লাস।

ব্রিকসের সদস্যভুক্ত ১১টি দেশ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ জনসংখ্যা ও বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের ৩৮ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এর বিপরীতে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি৭ বিশ্বের জনসংখ্যার ১০ শতাংশের কম এবং বিশ্ব অর্থনীতির ৩০ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। ৭ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন জি-৭ জোটের সদস্যদেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে একটা ঐকমত্যে আসা। জাপানে গিয়ে তাঁর আহ্বান ছিল, পশ্চিমা প্রভাবের জি-৭ জোট মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে যেন স্পষ্ট একটি স্বরেই কথা বলে। প্রশ্ন হচ্ছে ব্রিকসপ্লাস আরও স্পষ্ট করে বললে, ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু থাকা বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো কি গাজার ব্যাপারে একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে? ইসরায়েল-হামাস সহিংসতার ঘটনায় যে প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতে করে আমার মনে হয়েছে, বৈশ্বিক দক্ষিণে একই স্বরে কথা বলার সামর্থ্য রয়েছে। যদি একই স্বরে সেটা না বলা যায়, অন্তত সমস্বরে তারা সেটা বলতে পারে। এটা বিসদৃশ হবে না ঐতিহাসিক ভাবেই আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশ ফিলিস্তিনকে সমর্থন দিয়ে আসছে। ইন্দোনেশিয়া তো ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়নি। গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া, সত্যিই বিস্ময়কর। যদিও বিশ্বের ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে এবং এর প্রভাবে আন্তদেশীয় সম্পর্কের সমীকরণ বদলে যাচ্ছে। এর ফলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকেও এই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এর মধ্যে যেমন ঝুঁকি আছে, তেমনি লাভবান হওয়ার সুযোগও আছে। হামাসকে অকার্যকর করার ইসরায়েলের লক্ষ্য কতটা অর্জিত হবে, তার ওপর পরিস্থিতি নির্ভর করবে।

সে জন্য ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে স্থল অভিযানের কথা বলছে। তাতে সফল হলে তারা গাজার উত্তরাঞ্চল দখল করে, সেখানে ইসরায়েলি শাসন কায়েম করতে চায়। তবে এই পথে অনেক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। সবচেয়ে বড় কথা, এ বিষয়ে ইসরায়েলের পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয়। ইসরায়েলের ওপর মার্কিন চাপ বৃদ্ধি এবং গাজায় হামাসের প্রতিরোধও এই লক্ষ্য অর্জনে বাধা হতে পারে। সামরিক শক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং ফিলিস্তিনি সব মানুষকে শাস্তির যে পথ ইসরায়েল গ্রহণ করেছে, আন্তর্জাতিকভাবে তার সমালোচনা শুরু হয়েছে। যে কারণে বড় ধরনের স্থল অভিযান ইসরায়েলের জন্য গুরুতর নিরাপত্তা ও অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। গাজায় ইসরায়েলের স্থল অভিযান এই পরিবেশকে সংঘাতময় পরিবেশে রূপান্তরিত করতে পারে, যা ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট।

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত