বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের যে ভবনটিতে আগুন লাগে তার স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ।
গণমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, মূলত অফিস হবে জেনে সেই কাঠামোতে ওই ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল।
অথচ ভবনটি ব্যবহার করা হয়েছে রেস্তোরাঁ হিসেবে। রাজউক থেকে এ বিষয়ে কোনো অনুমোদন ছিল না।
যে কারণে রেস্তোরাঁ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা ছিল না ভবনটিতে।
ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ, একটি জুস বার (ফলের রস বিক্রির দোকান) ও একটি চা-কফি বিক্রির দোকান ছিল।
এ নিয়ে প্রতিনিয়ত উৎকণ্ঠায় থাকতেন এই স্থপতি।
যে কারণে ভবনটি নিয়ে লিখিতভাবে সতর্কও করেছেন, কিন্তু তার কথা মালিকপক্ষের কেউ কানে তোলেননি।
স্থপতি অভিযোগ করেন, ভবনটি নির্দিষ্ট ব্যবহারের ব্যত্যয় হওয়ায় স্থপতি হিসেবে তিনি রিপোর্ট ও এজ বিল্ট ড্রয়িং দেওয়া থেকে বিরত থেকে জমির মালিক, ডেভেলপারকে বারবার লিখিতভাবে সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু তার কথা কেউ শোনেনি।
মুস্তাফা খালিদ পলাশ বলেন, ‘সাত-আট বছর আগে ভবনটির নকশা করেছিলাম অফিসের জন্য। অনুমোদনও হয় বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে। কিন্তু এর ব্যবহার শুরু হয় রেস্তোরাঁ হিসেবে। ’
তিনি তথ্য দেন, ‘নিয়ম হলো, অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়ার পর ভবন ব্যবহার করবে। কিন্তু মালিকপক্ষ সেটি নেয়নি। ’
অনেক মালিকপক্ষই অর্থলোভের কারণে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট ছাড়া ভবন ব্যবহার করছেন বলে দাবি করেন তিনি।
এ স্থপতি বলেন, রেস্তোরাঁয় ভাড়া বেশি পাওয়া যায়, তাড়াতাড়ি ভাড়া হয়, যা অর্থলোভ ছাড়া কিছু নয়। মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টির ধার ধারেন না ভবনমালিকেরা।
তিনি বলেন, ‘এমন ভবনে একটি থেকে দুটি রেস্তোরাঁ থাকতে পারে, কিন্তু চার-পাঁচ গুণ করতে পারে না। এর তো অন্তত একটা নীতিমালা থাকা দরকার। কিন্তু সেটি কি আমাদের আছে? সাধারণত আগুন লাগে দুটি উৎস থেকে। একটি হলো শর্টসার্কিট, অন্যটা কিচেন থেকে। এখানে যতগুলো রেস্তোরাঁ ততগুলো চুলা, বিষয়টি তা নয়। একটি রেস্তোরাঁয় ৮ থেকে ১০টি চুলা থাকে এবং সেগুলো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন চুলা। সুতরাং চুলা যেখানে যত বেশি, সেখানে আগুন লাগার আশঙ্কা তত বেড়ে যায়। ’
তিনি বলেন, গুগলে যদি সার্চ দেওয়া হয় ‘রেস্টুরেন্ট অ্যারাউন্ড সাতমসজিদ রোড’—এত রেস্তোরাঁ যে লেখা পড়ে শেষ করা যাবে না। আমার জানা মতে হাজারের বেশি রেস্তোরাঁ সেখানে।
বেইলি রোড ট্র্যাজেডির মতো আরও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে সতর্ক করে মুস্তাফা খালিদ পলাশ বলেন, ঢাকা শহরে এ রকম রেস্তোরাঁ কালচার গড়ে উঠলেও এর কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি। একই ভবনে যদি অনেক রেস্তোরাঁ থাকে, তবে এ রকম দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
বেইলি রোডের ওই ভবনের বিষয়ে স্থপতি বলেন, ডেভেলপারকে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর আসে, তাদের নাকি ফায়ার লাইসেন্স আছে। কপি চাইলে দিতে পারেন না। রেস্তোরাঁ কেন দিলেন জানতে জমির মালিককে জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, ভাড়া হয় না তো আর কী করব! তখন তাদের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়, ব্যবস্থা না গ্রহণ করলে ভবনের স্থপতি হিসেবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর অভিযোগ করা হবে।
তিনি বলেন, ‘একজন স্থপতি হিসেবে নিজেকে অসহায় না ভেবে গত মাসে বেইলি রোড এলাকার ফায়ার সার্ভিস বিভাগের স্টেশন মাস্টারকে এ বিষয়ে অবগত করি। তিনি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন বলে জানান। আমার ঘনিষ্ঠ ফায়ার ডিপার্টমেন্টের সাবেক ডিজিকেও তার ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য অনুরোধ করি। তিনি তার সাধ্যমতো তা করবেন বলে জানান। আজ আবার স্টেশন মাস্টার সাহেবকে বিস্তারিত তথ্যসহ লিখলাম। দেখা যাক কী হয়। ’
মুস্তাফা খালিদ বলেন, ‘প্রতিবার যখন আগুনের ঘটনা ঘটে, কমিটি হয়। কিন্তু এরপর আর কিছু হয় না। আমি মনে করি, নীতিমালা ও তদারকি জরুরি, যেভাবে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে করা হয়েছে। প্রয়োজনে তৃতীয়পক্ষকে তদারকির দায়িত্ব দেওয়া যায়। ’
প্রসঙ্গত, দেশের অগ্রগণ্য স্থপতি, চিত্রশিল্পী ও সংগীতশিল্পী মুস্তাফা খালিদ পলাশ ডেলভিসটা ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং ভিসতারা আর্কিটেক্টসের প্রধান স্থপতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। একই সঙ্গে তিনি স্থাপত্যবিষয়ক পত্রিকা ‘ডট’-এর সম্পাদক। দেশের অসংখ্য নান্দনিক ভবন তৈরি হয়েছে তার হাত ধরে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বসুন্ধরা সিটি, বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার, ওয়েস্টিন হোটেল, ইউনিক ট্রেড সেন্টার, জিপি হাউস, মোবিল হাউস, বাংলালিংক হেডকোয়ার্টার, রবি হেডকোয়ার্টার, ল্যাবএইড হাসপাতাল ও চট্টগ্রামের র্যাডিসন হোটেল।