রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের প্রাণহানির পর ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ ও ভবনে অভিযান চালাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানী উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন এলাকায় এসব অভিযান পরিচালনা করছে। তবে এসব অভিযানকে সমন্বয়হীন, লোকদেখানো ও বেইলি রোড ট্র্যাজেডির ঘটনায় মানুষের ক্ষোভ সামাল দেওয়ার কৌশল বলে মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
তা বলেন, বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের আগে তেমন জোরালো কোনো অভিযান চালাতে দেখা যায়নি হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে। শুধু বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই অভিযানের নামে ধরপাকড় শুরু হয়। কিছুদিন পর মানুষের ক্ষোভ স্তিমিত হলে ফের আগের মতোই অভিযানের খোঁজ থাকে না সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের।
গতকাল মঙ্গলবার সংসদ অধিবেশনের অনির্ধারিত আলোচনায়ও বেইলি রোড ট্র্যাজেডি পরবর্তী অভিযানে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি উঠে আসে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য তারানা হালিম। তারা অভিযানে সমন্বয়ের ওপর জোর দিয়েছেন।
গতবৃহস্পতিবার বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের প্রাণ যায়। সেখানে অনুমতি না থাকলেও গড়ে উঠেছিল বহু রেস্তোরাঁ। ওই ঘটনার পর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় একই রকম অনিরাপদ পরিবেশে ভবন জুড়ে রেস্তোরাঁ গড়ে তোলার বিষয়টি আলোচনায় আসে। সমালোচনার মুখে গত রবিবার থেকে রাজধানীতে যে যার মতো করে অভিযানে নামে রাজউক, সিটি করপোরেশন, পুলিশ ও র্যাব। আবাসিক ভবনে নিয়মের বাইরে গিয়ে বানানো রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে এসব অভিযানে, আবার কোনো কোনো জায়গায় গ্রেপ্তার ও জরিমানাও করা হচ্ছে। তবে সরকারি সংস্থাগুলোর চালানো এ অভিযানের সমালোচনা করে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি একে হয়রানি বলে অভিযোগ করেছে।
নগর বিশেষজ্ঞ ও রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. এমদাদুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে ভবনের নকশার অনুমোদন দিয়েছে রাজউক, সেখানে ব্যবসা করার লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। আমরা দেখছি দুর্ঘটনার পর রাজউক অভিযান চালাচ্ছে একভাবে, সিটি করপোরেশন আরেকভাবে, পুলিশ চালাচ্ছে তাদের মতো করে। সংস্থাগুলোর অভিযান চলছে আলাদা। এখন যে অভিযান চলছে তাতে যদি সমন্বয় থাকত, তাহলে ভালো ফল পাওয়া যেত।
দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পেতে সমন্বিত অভিযানের ওপর গুরুত্ব দেন এ নগর বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, রাজউক বেইলি রোডে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়েছে। যাদের দোকান-রেস্তোরাঁ বন্ধ করা হয়েছে তারা আদালতে যাবেন। আদালতে রাজউকের আইনজীবীরা লড়াই করবেন। আদালতে ফায়ারের সমস্যা, সিটি করপোরেশন সমস্যার বিষয়ে কোনো তথ্য উপস্থাপন করার কোনো আইনজীবী থাকে না। যদি রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ একসঙ্গে তালিকা ধরে অভিযান চালিয়ে দোকান-রেস্তোরাঁ বন্ধ করা দেয়, তখন সংশ্লিষ্ট দোকান-রেস্তোরাঁ মালিক আদালতে গেলে সব সংস্থার আইনজীবীরা আদালতে তাদের পক্ষে মতামত তুলে ধরবেন। সব সংস্থার আইনজীবীরা তাদের ঝুঁকিসংক্রান্ত মতামত দিলে আদালত সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে সহসা অনুমতি দেবে না। এ কারণে অভিযানগুলো সমন্বয় করে চালানো উচিত। তবে এখন যে অভিযান চলছে এটা লোকদেখানো। অগ্নিকাণ্ডের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ দেখা গেছে, তা সামাল দেওয়ার একটি কৌশল হচ্ছে এ অভিযান।
একই ধরনের মত দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘এখন বিচ্ছিন্ন কোনো অভিযান কাজে দেবে না। বরং সব সেবা সংস্থা একত্রিত হয়ে যদি একটি অভিযান চালায় এবং অভিযানকালে কী কী জিনিস দেখবে তার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা হলে হয়রানি কম হতো, অভিযানগুলো সামনের দিনগুলোর জন্য ভালো বার্তা দিত। এখন অধিকাংশ অভিযান হয়ে গেছে মানুষকে হয়রানির হাতিয়ার। আমরা বারবার সমন্বয়হীনতার গল্প করি। সদিচ্ছা থাকলে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি নিয়ে অভিযান করা যায়। এতে সরকারেরও অর্থের সাশ্রয় হয়, ভোগান্তিও কম হয়। এ বিষয়গুলো কিন্তু সব সেবা সংস্থাই জানে, কিন্তু সমন্বয় করতে কোনো সংস্থাই আগ্রহী না। এত বড় ঘটনার পর কেন সমন্বিত অভিযান হবে না, তা একটি বড় প্রশ্ন।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেখা গেছে রেস্তোরাঁ বা দোকান মালিকরা বিভিন্ন সংস্থা থেকে ছাড়পত্র নিয়েছে। কিন্তু সমন্বিতভাবে না দেওয়ায় সংগতিপূর্ণ ছাড়পত্র হয়নি। সমন্বয়হীনতা বিষয়গুলো বারবার সামনে আসার পরও সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় না হওয়া হতাশাজনক।’
ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ বন্ধ ও তালিকা তৈরিতে ২৪ টিম: রাজউকের আওতাধীন এলাকার হোটেল-রেস্তোরাঁর তালিকা প্রস্তুত ও ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ বন্ধ করতে ২৪টি টিম গঠন করা হয়েছে। টিমগুলোকে ঢাকার সব রেস্তোরাঁ পরির্দশন করে ঝুঁকি ও অনিয়মের বিষয় উল্লেখ করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে এ প্রতিবেদন দিতে হবে। গতকাল দুপুরে রাজউকে অনুষ্ঠিত এক সভায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন এ নির্দেশ দেন। বৈঠকে পরিদর্শনকালে যেসব রেস্তোরাঁ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে পাওয়া যাবে সেগুলো সিলগালা করে দিতে বলা হয়। আর যেসব রেস্তোরাঁ কম ঝুঁকিতে আছে সেগুলোকে সংস্কার করে পরিচালনার ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। সভায় রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা ও সংস্থাটির শীর্যপর্যায়ের কর্মকর্তাসহ ২৪টি জোনের পরিচালক, অথরাইজড অফিসার, সহকারী অথরাইজড অফিসার, প্রধান পরিদর্শক ও পরিদর্শকরা উপস্থিত ছিলেন।
দুর্ঘটনার আগে খবর থাকে না অভিযানের: বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের পর রাজধানীতে একের পর এক অভিযানে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বহু রেস্তোরাঁ। গতকাল বেইলি রোডের সুলতানস ডাইন পরিদর্শনে যায় রাজউকের দল। সেখানে গিয়ে বন্ধ পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠানটি। সামনে ঝোলানো নোটিসে লেখা ছিল, ‘রেনোভেশন কাজের জন্য সাময়িকভাবে সুলতানস ডাইন বন্ধ রয়েছে।’ পরে বন্ধ থাকা রেস্টুরেন্টটি সিলগালা করে দেয় রাজউক।
অভিযানের খবর পেয়ে আগেই বন্ধ করে দেয় ‘নবাবী ভোজ’ নামের রেস্তোরাঁর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পরে রাজউকের দলের সদস্যরা রেস্তোরাঁটি সিলগালা করে দেন। গতকাল খিলগাঁও এলাকায়ও অভিযান চলে। যদিও অভিযানের খবর পেয়ে আগেই সেখানকার শহীদ বাকি সড়কের দুইপাশের শতাধিক রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেন মালিকরা।
খিলগাঁওয়ে অভিযান চালায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ফায়ার সার্ভিস। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া শাখার কর্মকর্তা আনোয়ার ইসলাম বলেন, ‘রেস্তোরাঁয় অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। আমরা সেই অভিযানে অংশ নিয়েছিলাম।’
সম্প্রতি বন্ধ হওয়া সবচেয়ে আলোচিত গাউসিয়া টুইন পিক টাওয়ারের একটি রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের রেস্টুরেন্টগুলো এখন বন্ধ আছে। কবে চালু হবে বলতে পারছি না। বেইলি রোডের দুর্ঘটনার আগে কোথায় ছিল এসব অভিযান? আমাদের যদি আগে থেকে সাবধান করে দিত তাহলে আমরা আমাদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারতাম। তাছাড়া ক্রেতারা মাঝেমধ্যেই রেস্টুরেন্ট চালু হবে কবে জানতে চাচ্ছে। কিন্তু কবে চালু হবে সেটিও তো আমরাই জানি না।’
পুরান ঢাকার ওয়ারীর বাসিন্দা মো. ফাহিম বলেন, ‘এ শহরের বিনোদনকেন্দ্রগুলো মানসম্মতভাবে এখনো গড়ে ওঠেনি। যার জন্য শুধু খাবারের জন্য নয়, আড্ডা দেওয়ার জন্যও মানুষ রেস্টুরেন্টে যায়। কিন্তু সমস্যা সমাধান না করে এভাবে কোনোরকম নির্দেশনা ছাড়া রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ করা ঠিক হয়নি।’
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, ‘রেস্টুরেন্ট বন্ধের নামে আমাদের হয়রানি করা হচ্ছে। কোনোরকম নির্দেশনা ছাড়া এভাবে রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ করার কোনো অর্থ বুঝতে পারছি না। আমরা অনেক লোকসানে পড়ে যাচ্ছি। বেকার হয়ে যাচ্ছে অনেক শ্রমিক। এখন শ্রমিকরা বড় পরিসরে আন্দোলনে যেতে চাচ্ছে। সেগুলো আমরা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি।’ এভাবে টানা অভিযান চললে একযোগে সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
খুলনায় রেস্টুরেন্টসহ ৮ প্রতিষ্ঠানকে শোকজ: আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণে অভিযান শুরু করেছে খুলনা উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (কেডিএ) ও ফায়ার সার্ভিস। গতকাল অভিযানের প্রথম দিনে অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় চারটি বাণিজ্যিক ভবনের রেস্টুরেন্টসহ আটটি প্রতিষ্ঠানকে শোকজ করা হয়েছে। চিঠিতে দেড় মাসের মধ্যে আবাসিক ভবন থেকে রেস্টুরেন্ট অপসারণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে সিলগালা করার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।