- সাবেক ভূমিমন্ত্রী বলেছেন, তার বাবার বিদেশের ব্যবসা ৫০ বছরের পুরনো। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার সময়ও ব্যবসা করেছেন। বাংলাদেশে ও যুক্তরাজ্যে তার আলাদা আয়কর নথি আছে।
বিদেশে সম্পদের বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরতে শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে আসেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও চট্টগ্রাম-১৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
যুক্তরাজ্যে সম্পদ ও ব্যবসা থাকার বিষয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি যে তথ্য দিয়েছে, সেটি স্বীকার করে নিয়েছেন চট্টগ্রাম-১৩ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
তবে সেই সম্পদ ও ব্যবসা বাংলাদেশ থেকে পাঠানো টাকায় করা হয়নি দাবি করে বলেছেন, তার বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে বিদেশে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি সেই ব্যবসার উত্তরাধিকারী। আর যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার সময়ও তিনি ব্যবসা করেছেন। যুক্তরাজ্যে তার আয়কর নথিও আছে।
করোনাভাইরাস মহামারীর সময় যুক্তরাজ্যে সম্পদ ও ব্যাংক ঋণের সুদহার কমে যাওয়ার পর ঝুঁকি নিয়ে লাভবান হয়েছেন, এমন একটি কথাও বলেছেন আওয়ামী লীগ নেতা।
তার এসব তথ্য যাচাইয়ে নাগরিক সমাজ ও সাংবাদিকদের নিয়ে কমিটি গঠনের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, দুর্নীতির প্রমাণ পেলে সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দেবেন।
বিদেশে সম্পদ ও ব্যবসা থাকার বিষয়টি সামনে আসার দুই মাসেরও বেশি সময় পর শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে আসেন সাইফুজ্জামান, যিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারা আসন থেকে টানা তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জিতে সংসদ সদস্য হয়েছেন।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী বলেন, “আমার ব্যবসায়িক ক্যারিয়ার ৩০ বছরের উপরে, প্রায় ৩৫ বছর হবে। আর আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ১১-১২ বছর। আমার বাবার বিদেশের ব্যবসা ৫০ বছরের উপরে। সুতরাং, আমার বাবা আমাকে এভাবে ট্রেইনড করে দিয়ে গেছে, যে দেশেও ব্যবসা করতে হবে, বিদেশেও ব্যবসা করতে হবে।
“শুধু লন্ডন-আমেরিকা নয়, যে দেশে সুযোগ আসে, সেই দেশে আমরা বিজনেস করি। এখানে লুকোচুরি করার কিছু নেই।”
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের শেষের নির্বাচনে সাইফুজ্জামানের আসনটি ছিল চট্টগ্রাম-১২। ওই বছর সেখানে জেতেন সাইফুজ্জামানের বাবা। ২০১২ সালের নভেম্বরের শুরুতে তিনি মারা গেলে উপনির্বাচনে নৌকা নিয়ে জয় পান সাইফুজ্জামান। পরের নির্বাচনে আসন পুনর্বিন্যাসে সেটি হয় চট্টগ্রাম-১৩।
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের পর মন্ত্রিসভায় ভূমি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৯ সালের শুরুতে নতুন সরকারে ভূমি মন্ত্রী হন তিনি।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে ২৬ ডিসেম্বর টিআইবি গত ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে, যার প্রতিফলন হলফনামায় নেই। মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনও বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছেন। যে সকল কোম্পানির মোট সম্পদ মূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।”
সরকার জানতে চাইলে তার নাম এবং এ বিষয়ক সব তথ্য ও তথ্যসূত্র দেওয়া হবে বলে জানালেও পরে ইফতেখারুজ্জামান বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমকে সেই ‘মন্ত্রীর’ নাম জানান। তিনি হলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় সাইফুজ্জামানের যুক্তরাজ্যে যে সম্পত্তি রয়েছে, সেগুলো অন্তত আটটি কোম্পানির কেনা। এসব কোম্পানির প্রতিটিতেই তার উল্লেখযোগ্য অংশীদারত্ব রয়েছে। কোম্পানিগুলো হল: আরামিট প্রপার্টিজ, রুখমিলা প্রপার্টিজ, সাদাকাত প্রপার্টিজ, নিউ ভেঞ্চারস (লন্ডন) লিমিটেড, জিটিএস প্রপার্টিজ, জেবা প্রপার্টিজ, জিটিজি প্রপার্টি ভেঞ্চারস লিমিটেড ও জারিয়া প্রপার্টিজ। এসব কোম্পানি ২০১০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তবে এসব ব্যবসার কোনো কিছুই নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া নেতার হলফনামায় উল্লেখ করেননি আওয়ামী লীগের নেতা। নির্বাচনের আগে গণমাধ্যমের কাছে এ নিয়ে তিনি কথাও বলেননি। তবে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় এক নির্বাচনি জনসভায় বলেছিলেন, “আমি এক টাকাও দুর্নীতি করেছি, কেউ বলতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেব। এমপি, মন্ত্রী হলেও আমি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান।
“ব্যবসা করেছি, ব্যবসা না করে আমি উপোস করে থাকব? চুরি করব নাকি আমি? মানুষের হক খেয়ে তো আমি চলতে পারব না। হারাম পয়সার আমার দরকার নেই। আমার পদ বেচে আমি ব্যবসা করি না, আমার এই পদের অনেক আগে, আমার বাবাও ব্যবসায়ী ছিলেন, আমিও ব্যবসায়ী ছিলাম।”
বিএনপির বর্জনের এই নির্বাচনে সাইফুজ্জামান বড় জয় পেয়েছেন। তবে নতুন সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান হয়নি তার।
‘বিদেশে বাবার ব্যবসা ৫০ বছর ধরে’
বিদেশে ব্যবসা তার বাবার করে যাওয়া উল্লেখ করে সাইফুজ্জামান বলেন, “আমার ক্যারিয়ারটাই হলো ব্যবসায়ী ক্যারিয়ার। আমার ব্যবসায়ী ক্যারিয়ার ৩০ বছরেরও বেশি। আমার বাবার বিদেশের ব্যবসা প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি।”
এই ব্যবসার অর্থ বাংলাদেশ থেকে নেওয়া হয়নি জানিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বলেন, “বাংলাদেশ থেকে যদি কোনো টাকা নিতাম অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নিতাম। যদি অনুমতি না নিয়ে বিদেশে টাকা নিতাম, তাহলে আমার অপরাধবোধ হত।”
আনোয়ারা ও কর্ণফুলী আসনের সংসদ সদস্য বলেন, “আমি আপনাদের (সংবাদকর্মী) অনুরোধ করব, আমার ব্যবসা এবং রাজনীতি দুটোকে মিক্স করবেন না। আমি ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ কাম ব্যবসায়ী নই। পারিবারিক সূত্রেও আমি ব্যবসায়ী। একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর সন্তান এবং দীর্ঘদিন ধরে আমি ব্যবসা করে আসছি। আমি আমার ব্যবসায়িক ক্যারিয়ার শুরু করেছি আমেরিকায় লেখাপড়া করার শেষ পর্যায়ে এসে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি আমেরিকায় পড়াশুনা করেছি আশির দশকে। আমার পড়াশোনা যখন শেষ পর্যায়ে, বিদেশে আমাদের যে পারিবারিক ব্যবসা ছিল, সেখান থেকে কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি আন্তর্জাতিক ব্যবসা করার জন্য।
“যেহেতু আমার বাবা ইংল্যান্ডের সঙ্গে ট্রেডিং ব্যবসা শুরু করেন ১৯৬৭ এ। ওই সূত্র থেকে আমাদের শুরু। ছোট বেলা থেকেই আমাদের লন্ডন-আমেরিকায় বাড়ি-ঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। ওই সূত্র থেকে আমাদের কাজ।
“আমাদের ট্রেডিং ব্যবসা, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, সুপার মার্কেট, রিয়েল এস্টেট এমন অনেক ব্যবসা ছিল। সেখান থেকে আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ হয়েছে।”
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। চট্টগ্রাম-১৩ আসনের সংসদ সদস্যের দাবি, তার বাবার বিদেশের ব্যবসা ৫০ বছর পুরনো।
করোনা ভাইরাস মহামারীর সময় ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা বাড়াতে পেরেছেন জানিয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী বলেন, “টিআইবির বিষয়টি নিয়ে আমি সারপ্রাইজড। এমন একটি সময় তারা নিউজটি জানাল, ঠিক নির্বাচনের সাত দিন আগে। এটা কি সরকারকে বিব্রত করার জন্য আমাকে দিয়ে? কেন?
“অনেকে বলছে, আমি মন্ত্রী থাকার সময় আমার ব্যবসা সম্প্রসারণ হয়েছে। হ্যাঁ, আমি এটা স্বীকার করছি। কেন আমি করেছি? কারণ, করোনার সময় বিশ্ব যখন লক ডাউন হয়ে গেল, তখন আমি দেখেছি, আমার জন্য সুযোগ এসেছে। ধাপ ধাপ করে রিয়েল এস্টেটের দাম পড়ে গেছে। ব্যাংক ঋণের সুদ কমে গেছে। আমি রিস্ক নিয়ে সেই সুযোগ নিয়েছি এবং ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছি।”
সাইফুজ্জামানের বাবা আখতারুজ্জামান বাবু ছিলেন চট্টগ্রামের একজন নেতৃস্থানীয় শিল্পোদ্যোক্তা। তিনি আরামিট গ্রুপ ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চেয়ারম্যান ছিলেন।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এর সভাপতি এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে চট্টগ্রামের আনোয়ারা-পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। পরে একই এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সাল থেকেই চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন।
হলফনামায় যে কারণে বিদেশে সম্পদের তথ্য নেই
নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় যে সম্পদের হিসাব দেওয়া হয়েছে, তাতে বিদেশে ব্যবসার তথ্য কেন নেই, তারও জবাব দিয়েছেন সাইফুজ্জামান।
তিনি বলেন, “নির্বাচনকালীন সময়ে যে হলফনামা করতে হয়, সেটি ট্যাক্স রিটার্নের সঙ্গে মিল রেখে হলফনামা করতে হয়। নির্বাচন হিসেবে আমি সর্বশেষ চতুর্থবার নির্বাচন করেছি। বিগত দিনে আমি যেভাবে আমার হলফনামাগুলো দিয়েছিলাম, এবারও সেভাবে দিয়েছি।
“ওই হলফনামায় কোথাও উল্লেখ নেই বিদেশের সম্পত্তি উল্লেখ করার জন্য। যেহেতু বিদেশের সম্পত্তি উল্লেখ করার জন্য কোনো কলাম নেই এবং বিগত নির্বাচনেও আমি এই বিষয়ে কোনো তথ্য দেইনি। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, আমি আমার বিদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সেভাবে পুরোটা মিক্স করিনি। কারণ, বাংলাদেশে আমার আলাদা ট্যাক্স রিটার্ন আছে, ইউকেতে আলাদা ট্যাক্স রিটার্ন আছে। ওই ট্যাক্স রিটার্নগুলো আমি মিক্স করিনি।
“আমি মনে করেছি, যেহেতু এটি হলফনামার কলামে নেই, আমি শুধু শুধু বাড়তি কথা কেন বলতে যাব? সে কারণে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছাড়াই আমি এটা করেছি। এখানে আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই।”
‘জবাব’ এতদিন পরে কেন?
বিদেশে সম্পদ ও ব্যবসা থাকার বিষয়ে আলোচনা তৈরি হলেও এতদিন কেন কোনো জবাব দেননি, সেই বিষয়টিও ব্যাখ্যা করেছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
তিনি বলেন, “গত কিছুদিন ধরে আমাকে নিয়ে বেশ কিছু নিউজ হয়েছে দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে। অনেকের প্রশ্ন যখন এই নিউজগুলো এলো, তখন আমি কেন নিরব ছিলাম? আসলে আমি তখন দেশের বাইরে ছিলাম।
“দেশের বাইরে থাকার সময় আমাকে নিয়ে নিউজগুলো এসেছে। আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দেশে এসে আমি একটি সংবাদ সম্মেলন করব, যেহেতু আমি রাজনীতি করি, একটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলাম, দায়িত্বে ছিলাম। মন্ত্রী হিসেবে জনগণের কাছে আমার দায়বদ্ধতা আছে, জবাবদিহিতা আছে।”
‘এক টাকার দুর্নীতি প্রমাণ হলেই পদত্যাগ’
মন্ত্রী হিসেবে কোনো দুর্নীতি করেননি দাবি করে সাইফুজ্জামান বলেছেন, কেউ এটি প্রমাণ করতে পারলে তিনি সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দেবেন।
তিনি বলেন, “আমি দলকেও বিব্রত করতে চাই না, সরকারকেও বিব্রত করতে চাই না। আমি খুশি হব, আমি মন্ত্রী থাকার সময় কোনো দুর্নীতি করেছি কি না এই বিষয়ে যদি একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি করা হয়।
“এই কমিটিতে একজন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, একজন সাংবাদিক ও সরকারের ঊর্ধ্বতন একজন প্রতিনিধি দিয়ে যদি কমিটি করা হয় তাহলে আমি খুশি হব। আমি মন্ত্রী থাকার সময় কী করেছি, এটা পরিষ্কার করা হোক। এটা আমার জন্য খুব কমফোর্টের ব্যাপার হবে। এই কমিটি যদি আমার বিরুদ্ধে এক টাকার দুর্নীতি পায়, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, আমি আমার পদ থেকে রিজাইন দেব। আমি খুবই পরিষ্কার মানুষ। খুবই সিনসিয়ারলি সততার সঙ্গে কাজ করি।”