ফেনীর ছাগলনাইয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার ২৩ বাংলাদেশি শ্রমিকের ভাগ্য নির্ধারিত হতে যাচ্ছে ভারতের আদালতে। চোরাচালানকারী হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করে স্থানীয় মনু বাজার থানায় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার মনুবাজার পুলিশ স্টেশনে তাদের হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিজিবির ফেনী ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক (৪ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা।
ওই ২৩ বাংলাদেশিদের ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফেনী ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক বলেন, বিএসএফ বিজিবির কাছে স্বীকার করেছে চোরাকারবারি হিসেবে তাদের থানায় হস্তান্তর করেছে। ফলে পতাকা বৈঠকে আর কিছু করার সুযোগ নেই। সে দেশের আদালত তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
ওই ২৩ বাংলাদেশির ভাগ্যে কি ঘটবে, কবে তারা দেশে ফিরতে পারবে এ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে গ্রেপ্তারকৃতদের স্বজনদের মাঝেও। গতকাল পূর্ব ছাগলনাইয়া সীমান্ত ফাঁড়ির সামনে স্বজনদের অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
গতকাল বুধবার সন্ধায় বিজিবি ও বিএসএফ এর কোম্পানী কমান্ডার পর্যায়ে বৈঠকে এ তথ্য জানিয়েছেন বিএসএফ।
ছাগলনাইয়ার মধুগ্রাম বিওপির আওতায় ২১৯৫ মেইন পিলারে এ পতাকা বৈঠকে অনুষ্ঠিত হয়। পতাকা বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন মধুগ্রাম বিওপির কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার জুলফিকার আলী এবং ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেন বিএসএফ এর মাদারগঞ্জ কোম্পানী কমান্ডার ইন্সপেক্টর মুক্তা মাজলী।
পূর্ব ছাগলনাইয়া বিওপির কমান্ডার নায়েব সুবেদার মো. আবদুর রশীদ পতাকা বৈঠকের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ভারতীয় বিএসএফের হাতে আটক ২৩ বাংলাদেশিকে আদালতের মাধ্যমে হাজতে পাঠানো হয়েছে। আটককৃতদের মেডিকেল হয়েছে। তারা সবাই ভালো আছে। বিষয়টি নিচের লেভেলের হাতে নেই। এটি উচ্চ পর্যায়ে চলে গেছে। যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ায় তারা ফেরত আসবে।
গ্রেপ্তারকৃতদের স্বজনদের দাবি, বিএসএফ’র হাতে গ্রেপ্তার হওয়া কেউ পাচারকারী দলের সদস্য নয়, তাদের চিনি পাচারে নিয়োজিত করেছিল একটি চক্র। বিএসএফ’র হাতে পাচারকারী চক্রের মূলহোতারা ধরা না পড়লেও ফেঁসে গেছেন তারা। তবে ধরে নেয়ার দুইদিন পরও আটককৃতদের কারও পরিবার কিংবা স্বজনদের পক্ষ থেকে থানায় কেউ অভিযোগ করেনি বলে নিশ্চিত করেছেন ছাগলনাইয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাসান ইমাম। বেলাল হোসেন নামে আটককৃত ব্যক্তির পিতা জানান, ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পূর্ব ছাগলনাইয়া ফাঁড়িতে জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধনের কপি জমা দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চোরাচালানের সময় মূলহোতারা সীমান্তে থাকেন না। তবে তাদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকে। সীমান্ত থেকে ভারতীয় চিনি পাচার স্থানীয় শতাধিক বেকার যুবক ও দিনমজুরের আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্তের কাঁটাতার থেকে দেশের অভ্যন্তরে এক বস্তা চিনি বহন করে আনলে বস্তাপ্রতি ২ থেকে ৩শ টাকা মুজুরি দেওয়া হয়। এতে করে এলাকার বেকার ও কর্মহীন দিনমজুররা প্রতিদিন অন্তত ১/২ হাজার টাকা আয় করতে পারে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ছাগলনাইয়া উপজেলাধীন রাধানগর, মহামায়া, শুভপুর ইউনিয়ন এবং পৌর এলাকার সীমান্তবর্তী এলাকার সব কয়টি স্থান চোরাচালানের নিরাপদ রুট হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন অবাধে ভারতীয় চিনি, শাড়ি, কাপড়, মাদকসহ বিভিন্ন অবৈধ মালামাল চোরাচালান হচ্ছে। দিনে রাতে প্রকাশ্যে এসব অবৈধ মালামাল ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচারের দৃশ্য দেখে স্থানীয়রা অনেকটা আতঙ্কে থাকেন বলেও জানান। গত সোমবার রাতের ঘটনায় এর সত্যতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এসব চোরাচালানের সাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ছাড়াও কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি সম্পৃক্ত থাকার কথা বলছেন স্থানীয়রা। গভীর রাতে ভারতীয় সীমান্ত থেকে শাড়ি, কসমেটিক ও মাদক এবং দিনে ও রাতে চিনি বাংলাদেশে নিয়ে আসার তথ্য দিয়েছেন তারা।
ছাগলনাইয়া পৌর শহরের জমদ্দার বাজারের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, জমদ্দার বাজারস্থ মধুমতি মার্কেট সংলগ্ন স্থানে রাত একটার পর শত শত বস্তা ভারতীয় চিনি ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।
আটক হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- সাইমুম হোসেন, রাইসুল ইসলাম, সামিন, হারুন, লিটন, মাঈন উদ্দিন, মহসিন, কাজী রিপন, তাজুল ইসলাম সাকিল, হানিফ, আবুল হাসান, ইমরান, রুবেল, জাফর ইমাম মজুমদার, ওবায়দুল হক, জামাল উদ্দিন, আরিফ হোসেন, করিম, খোরশেদ, আজাদ হোসেন, মাহিম, হারুন ও ইমাম হোসেন। তাদের সবার বাড়ি সীমান্ত ঘেঁষা পূর্ব ছাগলনাইয়া, মটুয়া ও রাধানগর এলাকায়।
এদিকে বিএসএফের বরাত দিয়ে ত্রিপুরার দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক দীপান্ত মজুমদার জানান, দক্ষিণ ত্রিপুরার সমরগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২৩ জন বাংলাদেশি পাচারকারীর কাছ থেকে ১২৫টি ব্যাগে মোট ছয় হাজার ২৫০ কেজি চিনি উদ্ধার করা হয়েছে। জব্দ করা হয় ১৭টি মোবাইল ফোন।
ফেনী-৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা বলেছেন, চোরাকারবারীর অভিযোগে ২৩ বাংলাদেশিকে আটক করেছে বলে পতাকা বৈঠকে দাবি করে বিএসএফ। বৈঠকে আটককৃতদের একটি তালিকাও দিয়েছে বাহিনীটি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে আইনগত প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।