- পথ খুঁজছেন বিএনপির সাজাপ্রাপ্ত পলাতকরা
- শতাধিক মামলায় ১৬৮৭ নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পুরনো মামলায় বিএনপি নেতাদের একের পর এক সাজা দেওয়া হয়েছিল। দলটির দপ্তরের তথ্যমতে, গত পাঁচ মাসে শতাধিক মামলায় ১ হাজার ৬৮৭ নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। এর মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে রয়েছেন ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাও। কোনো কোনো নেতার একাধিক মামলায় ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৭ বছর পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাদের কেউ আছেন কারাগারে, কেউ রয়েছেন আত্মগোপনে।
বিএনপির একাধিক সাজাপ্রাপ্ত পলাতক নেতা বলেন, ‘তিন মাসের বেশি সময় ধরে বাসায় ফিরতে পারছি না। বাচ্চাদের আকুতি বাবার কোলে ঘুমাবে। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানোর কারণে বাচ্চাদের আকুতি পূরণ করতে পারছি না। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পাশাপাশি আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হন্য হয়ে খুঁজছে। আজ এখানে তো কাল আরেকখানে রাত কাটাচ্ছি। পাশাপাশি পথ খুঁজছি কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরব। দলের সিদ্ধান্ত ও আইনজীবীদের পরামর্শ নিয়ে শিগগিরই আইনি প্রক্রিয়া শুরু করব।’
তারা বলেন, ‘পরিবার-পরিজন ছাড়া এই পলাতক অবস্থা থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই আমরা। ইতিমধ্যে দলের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা হয়েছে। দলের হাইকমান্ড আইনজীবীদের নির্দেশনা দিয়েছেন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক নেতাদের জামিনের প্রক্রিয়া শুরু করতে। আশা করছি শিগগিরই আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পারব।’
সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের বিষয়ে দলের আইনজীবীরা কী উদ্যোগ নিচ্ছেন জানতে চাইলে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও দলের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে হওয়া পুরাতন মামলায় একের পর এক সাজা দিয়েছে। নির্ধারিত সময়ের বাইরে গিয়ে রাতের বেলা সাজা দিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, নেতাদের সাজার আদেশ দিলেও বিচারকরা রায় লেখেননি। রায় না লেখার কারণে আমরা আইনজীবীরা আদালতে গিয়ে রায়ের কপির জন্য ধরনা দিলেও সাজাপ্রাপ্ত পলাতকরা অনুলিপি পাচ্ছি না। অনুলিপি না পাওয়ায় জামিনের আবেদন করতে পারছি না। তবে আমাদের কার্যক্রম চলছে আদালত কর্তৃক দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে পালিয়ে থাকা নেতাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার।’
সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের বিষয়ে দল কী ভাবছে, তারা এখন কী করবেন, দলের সিদ্ধান্ত কী জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের আদালতে আত্মসমর্পণ করার কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। তবে সাজাপ্রাপ্ত নেতারা দলীয় আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নিজ নিজ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’
এদিকে সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ নির্বাচনের আগে রাজপথের কর্মসূচিতে এক কিংবা একাধিক দিন অংশ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল, বিএনপির সহ-স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, নির্বাহী কমিটির সদস্য আকরামুল হাসান মিন্টুকে রাজপথের কর্মসূচিতে দেখা গেছে।
বিএনপির দপ্তর-সংশ্লিষ্ট নেতারা বলেন, ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকার যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ভাটারা থানায় মামলা করে পুলিশ। এ মামলায় গত বছরের ৯ অক্টোবর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এম শাহজাহান, দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবসহ ১৫ জনকে ৪ বছর করে কারাদন্ড দেয় আদালত। নির্বাচনের আগে তিনিসহ অন্য আসামিরা আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাদের জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। পরে নির্বাচনের আগেই জামিনে ছাড়া পান তিনি। তার সঙ্গে কারাগারে যাওয়া জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সাবেক নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য আহসান হাবীব লিংকন, বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান, বিএনপি নেতা বেলাল আহমেদ, মনিরুল হক জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
বিভিন্ন মেয়াদে বিএনপির সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ শাজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনু, যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসান, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম জাহাঙ্গীর, সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সহ-সম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান, গ্রাম সরকারবিষয়ক সহ-সম্পাদক বেলাল আহমেদ, সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম, হাবিবুর রশিদ, আকরামুল হাসান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়ন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনূস মৃধা, মো. মোহন, হাজি মনির, মোশাররফ হোসেন খোকন, রংপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকু ও মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মাহফুজ উন নবী ডন, রাজশাহী জেলা বিএনপি সভাপতি আবু সাঈদ চাঁদ প্রমুখ। এ ছাড়া যুবদল, ছাত্রদল এবং অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনের আগে ৬ মামলায় ১৭ বছর ৮ মাসের সাজা হয়েছে যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারের। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা এই নেতা গতকাল বুধবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আমাদের দলের মহাসমাবেশ পন্ড করে দেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এরপর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সারা দেশের অসংখ্য নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তখন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘দেশের প্রচলিত আইন সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ এক রকম। আবার বিএনপি নেতাদের ক্ষেত্রে আরেক রকম। আমার বিরুদ্ধে হওয়া মামলা রাজনৈতিক। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাজা দেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতে এখন আত্মগোপনে রয়েছি। দলের সিদ্ধান্ত পেলে পদক্ষেপ নেব।’
তিনি বলেন, ‘দলের দু-একজন সাজাপ্রাপ্ত নেতা জামিনে মুক্ত হলেও আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। কারণ আমার ভাই ইয়াকুব সরকার বর্তমানে কারাগারে। তার আড়াই বছরের সাজা হয়েছে। জামিনের আবেদন করা হয়েছে, কিন্তু জামিনের শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে মার্চ মাসে। এভাবে আমার ক্ষেত্রেও বিলম্ব হতে পারে।’
বিএনপির স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সহ-সম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে গত তিন মাসে ৫টি মামলায় ১৫ বছর তিন মাসের সাজা দিয়েছে আদালত। তিন মাসের বেশি সময় ধরে আত্মগোপনে থাকা জুয়েল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় দীর্ঘ তিন মাসের বেশি সময় বাসাবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। অবুঝ ছোট্ট বাচ্চারা কান্নাকাটি করে বাসায় যেতে বলে কিন্তু বাবা হিসেবে বাচ্চাদের আবদার পূরণ করতে পারছি না। বাচ্চারা ফোন করে বলে বাবা বাসায় আসো না কেন? কবে বাসায় আসবা? ছোট্ট দুই মেয়ে কাগজে লিখেছে, “প্লিজ কাম, প্লে উইথ”। এরপর তার ছবি তুলে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েছে। বাবা হিসেবে আমি তখন আর নিতে পারি না।’
তিনি বলেন, ‘সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ছিলাম। এখনো আছি। ভবিষ্যতেও থাকব। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম সফল করে তবেই ঘরে ফিরব। পাশাপাশি দলের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে ও দলীয় আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে আত্মসমর্পণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’