- চাঁদার ভাগ পান রাজনৈতিক ব্যক্তি, পুলিশ, বিআরটিএ কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনসের প্রতিনিধিরা।
দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়। আর এ চাঁদার ভাগ পায় দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবসায় শুদ্ধাচার’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘চাঁদাবাজির এ হিসাব খুবই রক্ষণশীল। বাস্তবে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি চাঁদাবাজি হয়। এ চাঁদার ভাগ নানা পর্যায়ে যায়। যেহেতু খাতটি রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে, সেহেতু চাঁদার নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। এ খাতটি আপাদমস্তক দুর্নীতিতে জর্জরিত। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এ খাত জিম্মি হয়ে আছে। ফলে যাত্রীরা প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না।
গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের বৃহৎ বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশ পরিচালনার সঙ্গে রাজনীতিবিদরা সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়া যাত্রীদের ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, একশ্রেণির অসাধু যারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পুরো খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকারের নির্ধারিত আইন বা নীতিমালাগুলো বাস্তবায়ন করার সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এ শ্রমিক মালিক সংগঠনগুলো। অর্থাৎ তারাই সরকারের তুলনায় বেশি ক্ষমতাবান অনেক ক্ষেত্রে। এজন্য এ খাতে আমরা প্রত্যাশিত মান অনুযায়ী সেবা পাচ্ছি না।
এর আগে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন মুহাম্মদ নূরুজ্জামান ফারহাদ, ফারহানা রহমান ও মোহাম্মদ নূরে আলম। গবেষণা প্রতিবেদনে টিআইবি জানায়, সড়কে বাণিজ্যিকভাবে চলাচলকারী প্রত্যেকটি বাসের জন্য নিবন্ধন ও তিন ধরনের সনদ বাধ্যতামূলক থাকলেও ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ বাসকর্মী ও শ্রমিকের মতে, সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এক বা একাধিক বাসের নিবন্ধনসহ কোনো না কোনো সনদের ঘাটতি আছে। সংস্থাটির দাবি, ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ বাসের নিবন্ধন, ২৪ শতাংশ বাসের ফিটনেস, ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ বাসের ট্যাক্স টোকেন ও ২২ শতাংশ বাসের রুট পারমিট নেই।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাসকর্মী বা শ্রমিকদের মতে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ কোম্পানির সিটি সার্ভিস বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়, আন্তঃজেলায় হয় ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ কোম্পানির বাসে। নারী বাসযাত্রীদের ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ যাত্রাপথে কোনো না কোনো সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বা হতে দেখেছেন। এই হার আন্তঃজেলা বাসের ক্ষেত্রে ১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সিটি সার্ভিসের ক্ষেত্রে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ। এসব ঘটনায় যাত্রীরা ৮৩ দশমিক ২ শতাংশ সহযাত্রী ও ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ হেলপারকে দায়ী করছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছ থেকে বাসের নিবন্ধনসহ বিভিন্ন প্রকার সনদ ও ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে বাসমালিক ও চালকদের সময়ক্ষেপণসহ বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির শিকার হতে হয়। মোটরযান নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বাসপ্রতি গড়ে ১২ হাজার ২৭২ টাকা ঘুষ দিতে হয়, ফিটনেস সনদ ইস্যুর ক্ষেত্রে ৭ হাজার ৬৩৫ ও রুট পারমিট ইস্যুর ক্ষেত্রে ৫ হাজার ৯৯৯ টাকা ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ দেওয়া বাসের হার যথাক্রমে ৪১ দশমিক ৯, ৪৬ দশমিক ৩ ও ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ছাড়া ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশকে আন্তঃজেলা-দূরপাল্লার বাসপ্রতি মাসে ঘুষ দিতে হয় ১ হাজার ১৯ টাকা, আন্তঃজেলা-আঞ্চলিক বাসপ্রতি মাসে ঘুষ দিতে হয় ১ হাজার ১৩৩ ও সিটি সার্ভিস বাসে বাসপ্রতি মাসে ঘুষ দিতে হয় ৫ হাজার ৬৫৬ টাকা। গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ৯০০ কোটি টাকা বিআরটিএ নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায় করে।