দেশের সব সরকারি কলেজ স্ব স্ব জেলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে দেওয়ার জন্য অনুশাসন দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রায় ১০ বছর আগে এই অনুশাসন দেওয়া হলেও এতদিনেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে অধিভুক্ত কলেজের ভারে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার দিকে খুব একটা নজর দিতে পারেনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ায় প্রতিনিয়ত তাদের আয় বেড়েছে। অবশেষে উচ্চশিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটাতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এর আগে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের ফলেই কিছুটা দেরিতে হলেও রাজধানীর সাত সরকারি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত হয়। শুরুতে নতুন প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থীর ভার নিয়ে ঢাবি কর্র্তৃপক্ষ চাপে পড়লেও এখন সবকিছু অনেকটাই গুছিয়ে এনেছে। কমিয়ে এনেছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। নজর দিয়েছে শিক্ষার মানোন্নয়নের দিকে। এরই মধ্যে যার সুফল পেতে শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। বাড়ছে এই সাত সরকারি কলেজের উচ্চশিক্ষার মান।
কিন্তু একই সময়ে দেশের অন্যান্য সরকারি কলেজও স্ব স্ব জেলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে যাওয়ার কথা থাকলেও তা কোনো কারণে আটকে যায়। সরকারি কলেজগুলোতে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। এত শিক্ষার্থী যাতে কোনোভাবেই ছুটে না যায়, সেজন্য অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তি হতে দেয়নি সরকারি কলেজগুলোকে। ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তি থেকে মানের দিক দিয়ে তলানিতে ঠেকেছে শিক্ষার্থীরা।
তবে নবনিযুক্ত শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী দায়িত্ব নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। সরকারি কলেজগুলোকে অধিভুক্ত করে অ্যাকাডেমিক মনিটরিংয়ের (শিক্ষার মানে নজরদারি) দায়িত্ব নিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে শুরতেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আন্ডারগ্রাজুয়েট (স্নাতক) কোর্স চালু না করে সরকারি কলেজের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের দায়িত্ব নিতে বলেছেন মন্ত্রী।
সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত কলেজকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সেখানেও হয়তো চ্যালেঞ্জ আছে। সেই চ্যালেঞ্জটা তো আমরা অতিক্রম করছি। সাত কলেজের মান ইম্প্র“ভ (উন্নত) হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি অ্যাকাডেমিক স্ট্যান্ডার্ড মনিটরিংয়ের কাজ করতে পারে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন করতে পারবে না। এসব ক্ষেত্রে আইন সংশোধন করতে হলে মন্ত্রণালয় তা করবে।’
শিক্ষামন্ত্রী উপাচার্যদের আরও বলেন, ‘ওপেন ইউনিভার্সিটি (উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়) সারা দেশের নন ফরমাল এডুকেশনের (অ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা) অ্যাকাডেমিক মনিটরিংয়ের কাজটা করছে, তাহলে কেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম কলেজের অ্যাকাডেমিক মনিটরিংয়ের কাজ করতে পারবে না। ১৯৯২ সালের আগে তো তারাই মনিটরিং করত। আগে যদি করার ক্যাপাসিটি (সক্ষমতা) থেকে থাকে তাহলে এখন তো সক্ষমতা আরও বাড়ার কথা।’
জানা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা দুই হাজার ২৫৭টি। আর এসব প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত প্রায় ২৮ লাখ শিক্ষার্থী। এরমধ্যে সরকারি কলেজের সংখ্যা ৫৮৩টি। তবে তার মধ্যে ৩৭৩ সরকারি কলেজে স্নাতক পর্যায়ে পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র সরকারি কলেজে মোট শিক্ষার্থীর ৬০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১৭ লাখ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। সরকারি কলেজগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গেলে এসব শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমে যাবে।
সরকারি-বেসরকারি কলেজ মিলিয়ে স্নাতক (পাস) পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৩ লাখ ৫৫ হাজার ২১ জন। এর মধ্যে ছাত্রী আট লাখ পাঁচ হাজার ৭৮৮ জন। আর স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৭৪ জন। এরমধ্যে ছাত্রী ছয় লাখ চার হাজার ৩০৩ জন। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা এক লাখ ২৯ হাজার ৬৫৪ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ৫১ হাজার ৮৬৩ জন। এছাড়া সার্টিফিকেট ও ডিপ্লোমা পর্যায়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৯ হাজার ১৮৫ জন। এর মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা সাত হাজার ৬৭৪ জন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে সারা বছরই কোনো না কোনো পরীক্ষা থাকে। আর অধিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এসব পরীক্ষার ফরম পূরণ, রেজিস্ট্রেশনসহ নানা খাতে আদায়কৃত অর্থের বড় অংশই পায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও কলেজ পর্যায়ে যত্রতত্র উচ্চশিক্ষা চালু করলেও এর মানের দিকে তেমন একটা খেয়াল নেই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের। তারা পরীক্ষার ফরম পূরণ, রেজিস্ট্রেশন, ভর্তি নিয়েই বেশি ব্যস্ত। তবে তাদের তহবিলে জমা হচ্ছে শত শত কোটি টাকা। আয়ের এসব টাকা তারা নিজেদের প্রয়োজনমতো খরচ করছেন।
বেসরকারি কলেজের তুলনায় সরকারি কলেজের সংখ্যা কম হলেও সরকারিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় সমানে সমান। এখন সরকারি কলেজগুলো স্ব স্ব জেলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে গেলে আয়ে বড় ধরনের ছেদ পড়বে। এতে আর্থিক সংকটে পড়তে হবে। তাই প্রকাশ্যে বিরোধিতা না করলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় চায় সরকারি কলেজগুলো তাদের অধীনেই থাকুক।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনের সুপারিশে একাধিকবার বলেছে, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ থেকে স্নাতক সনদধারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ এবং তাদের গুণগত মানও আশানুরূপ নয়। এতে উচ্চশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও শিক্ষার প্রত্যাশিত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুযায়ী সাতটি সরকারি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো করছে, আবার কোথাও দুর্বলতা রয়েছে। এখন সরকারি কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে গেলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীই চলে যাবে। এতে আমরা এখন যেভাবে চলছি, সেটা হয়তো সম্ভব হবে না। তাহলে হয়তো আমাদের সরকারের বেতন কাঠামোতে নিয়ে আসতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে চেষ্টা করবে। অ্যাফিলিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কাজ তা আর থাকবে না। এরপরও সরকার যেভাবে গাইডলাইন (নির্দেশনা) দেবে সেভাবেই আমরা কাজ করব।’
সরকারি কলেজগুলো স্ব স্ব জেলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গেলে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে বলেও মনে করেন অধ্যাপক মশিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘সরকারি কলেজগুলো যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যায় তাহলে তাদের আবার কলা, মানবিকের মতো বিভাগ খুলতে হবে। আবার যদি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যায়, তাহলে তাদের বিজ্ঞানের বিষয় খুলতে হবে। এতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের চরিত্র হারাবে। তবে চট্টগ্রাম, রাজশাহীর মতো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে আবার এই সমস্যায় পড়তে হবে না। এখন একটা ব্যাপার হতে পারে, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলাবরেশন (দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা) বাড়ানো যেতে পারে। আমাদের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি নেই। তাতে সবার স্ব স্ব অবস্থান বজায় থাকবে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও হয়তো এ ব্যাপারে ভাবছেন। এরপর আমরা পুরো স্ট্রাকচার (কাঠামো) নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেই একটি সিদ্ধান্তে আসব।’
২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয় রাজধানীর সরকারি সাত কলেজকে। এরপর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে কলেজগুলোর ভর্তি কার্যক্রম। প্রতি বছর স্নাতক পর্যায়ে এই কলেজগুলোতে ২১ হাজার ৫১৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান। এই কলেজগুলো হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ এবং সরকারি বাঙলা কলেজ।
জানা গেছে, সাত কলেজের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা একটি উইং খুলেছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপ-উপাচার্যকে প্রধান সমন্বয়ক এবং কলেজগুলোর মধ্য থেকে একজন অধ্যক্ষকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে একাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো করেই কারিকুলাম, সূচি প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশ করা হচ্ছে। ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। অন্যদিকে কমিয়ে আনা হয়েছে কলেজগুলোর আসন সংখ্যা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যদি অন্য জেলার সরকারি কলেজগুলোও ওই জেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চলে যায়, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো করেই চলবে। সেক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মডেল হিসেবে নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এতে সাত কলেজ পরিচালনা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যেসব সমস্যায় পড়তে হয়েছে, সেসব সমস্যায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পড়তে হবে না। তবে অনেক জেলার নতুন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আবার কিছু জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সেখানে হয়তো পাশের জেলার বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারি কলেজ চলে গেলেও তাদের অধিভুক্ত এক হাজার ৬৭৪ বেসরকারি কলেজ থেকে যাবে। শুধু পরীক্ষার দায়িত্ব না নিয়ে সেগুলোর সার্বিক দায়িত্ব যদি তারা নেয়, তাহলে তাদের শিক্ষার মান উন্নত হতে বাধ্য।