পাকিস্তানে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সরকার গঠন নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) মহাসচিব ওমর আইয়ুবকে বেছে নিয়েছেন কারাবন্দি নেতা ইমরান খান। ওমর পাকিস্তানের সাবেক সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের নাতি। বর্তমানে তিনি পিটিআইয়ের মহাসচিব।
আইয়ুব খানের দ্বিতীয় ছেলে গহর আইয়ুব ওমরের বাবা। ওমর এই পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম যিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। এর মাধ্যমে দেশটির রাজনীতি এখনও আইয়ুব খানের লিগ্যাসি বহন করছে।
১৯৩৭ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন গহর আইয়ুব। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেন এবং ক্যাপ্টেন হিসেবে আগাম অবসর নেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের এডিসি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন গহর। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে তিনি রাজনীতিতে নাম লেখান এবং ১৯৭৭ সালে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের টিকিটে হরিপুর থেকে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
১৯৯৭ সালে নওয়াজ শরিফ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন গহর আইয়ুব। পরে পানি ও বিদ্যুৎমন্ত্রী হন। তারও আগে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রায় দুই দশক ধরে রাজনীতি করছেন ওমর। আগে পিএমএল-এন ও পিএমএল-কিউ দলের রাজনীতি করেছেন। ২০১৮ সালে তার রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তন আসে। ইমরান খানের হাত ধরে পিটিআইতে যোগ দেন ওমর। ইমরানের সরকারে জ্বালানিসহ তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি।
১৯৯৩ ও ১৯৯৬ সালে জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ওমর। ২০০৭ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ফোরাম (ডব্লিউইএফ) তাকে ইয়াং গ্লোবাল লিডার স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭০ সালের ২৬ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া ওমর ২০০২ সালের নির্বাচনে প্রথম জাতীয় পরিষদ সদস্য হন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শওকত আজিজের মন্ত্রিসভায় তিনি অর্থ-প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
২০২৩ সালের মে মাসে পিটিআইয়ের নেতা-কর্মীদের ওপর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের মধ্যে দলটির মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ পান ওমর। তিনি দলের হাতে গোনা কয়েকজন নেতাদের মধ্যে অন্যতম যিনি প্রতিকূল পরিবেশেও ইমরানের সঙ্গে ছিলেন।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে ওমরের দাদা আইয়ুব খানের শাসনামল খুবই ঘটনাবহুল। ১৯৫৮ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তিনি। এরপর নিজস্ব ধ্যানধারণা থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করে আলোচিত-সমালোচিত হন। আইয়ুব খানের বাবা মীর দাদ খান ছিলেন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক অশ্বারোহী রেজিমেন্টের রিসালদার মেজর।
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা নির্বাচিত সংসদীয় সরকারকে উৎখাত করে আইয়ুব খানের যোগসাজশে দেশে সামরিক আইন জারি করেন। তিনি আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু উচ্চাভিলাষী আইয়ুব খান এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। মাত্র তিন সপ্তাহ পর ২৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মির্জাকে উৎখাত করেন আইয়ুব খান এবং পর দিন এক আদেশ জারির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
ক্ষমতা গ্রহণের পরপর ইস্কান্দার মির্জাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেন তিনি। বরখাস্ত করেন ১৩ জন জেনারেলকে। নিজেকে ভূষিত করেন ফিল্ড মার্শাল উপাধিতে। এছাড়া রাজধানী প্রথমে করাচি থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে, পরে ইসলামাবাদে স্থানাস্তর করেন।
আইয়ুব খান অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নতুন শিল্প–কলকারখানা নির্মাণ, সড়ক নির্মাণ, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পণ্য রপ্তানি ও অনুন্নত শিল্পের জন্য কর রেয়াত সুবিধা দেন। তার আমলে বৈদেশিক বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। তার শাসনকালকে অখণ্ড পাকিস্তানের সবচেয়ে সফল দশক আখ্যায়িত করা হয়। তবে তার এ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত হয় পূর্ব পাকিস্তান, যার ফলে ১৯৭১ সালে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। ১৯৭৪ সালে তার মৃত্যু হয়।