- একুশে বইমেলার সমাপনী দিনে শনিবার ছিল কেবলই বই কেনার পালা।
- অমর একুশে বইমেলার এবারের আয়োজনে নতুন বই প্রকাশ হয়েছে ৩ হাজার ৭৫১টি। ৬০০ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। মেলায় ৯ শতাধিক স্টল ও ৬৭০টি প্রকাশনী ছিল।
শেষ হলো বাঙালির প্রাণের অমর একুশে বইমেলা। বিদায়ের সুরে পর্দা নামলো এবারের অধিবর্ষের বইমেলায়। একইসঙ্গে শুরু হলো আগামী বছরের ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রতীক্ষা।
চলতি বছরের আয়োজনে ৬০ কোটি টাকার বেশি বই বিক্রি হয়েছে। নতুন বই প্রকাশ হয়েছে ৩ হাজার ৭৫১টি। গত বছর মেলায় বিক্রি হয়েছিল ৪৭ কোটি টাকা মূল্যের বেশি। আর নতুন বইয়ের সংখ্যা ছিলো ৩ হাজার ৭৩০টি৷
এবারের মেলায় শুক্রবার (১ মার্চ) পর্যন্ত দর্শনার্থীর সংখ্যা ৬০ লাখের কাছাকাছি। নতুন ৬০০ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। মেলায় ৯ শতাধিক স্টল ও ৬৭০টি প্রকাশনী ছিল।
৬০ লাখ দর্শনার্থীর মেলায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি
শেষ দিন শনিবার বইমেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা মেলে ভিন্ন চিত্র। অন্তিম দিনে ছিলো না অন্যান্য দিনের মতো ভিড়। অন্য দিনের তুলনায় জমেনি মেলাও। দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। স্টলে স্টলে শুধুই ক্রেতা ও পাঠকের ভিড়। বইপ্রেমীদের ব্যাগ ভর্তি বই কিনতে দেখা যায়। অধিকাংশ পাঠককে হাতে বই নিয়ে ঘুরতে দেখা গেছে। বই ছাড়া মেলা প্রাঙ্গণ ছাড়ছিলেন না কেউই।
এদিন ব্যস্ত সময় পার করেন বিক্রেতা ও প্রকাশকরা। সঙ্গে ছিলেন লেখকরাও। মেলার শেষ দিন হওয়ায় বই গোছাচ্ছেন কর্মীরা। প্রদর্শনী থেকে বইগুলো প্যাকেজিং করে বিদায়ের জন্য প্রস্তুতি নেয়া চলতে থাকে সন্ধ্যার পর থেকেই। তবে বাংলা একাডেমির নির্দেশনায় কোনো প্রকাশনীই এদিন অবশিষ্ট বই মেলা থেকে নিয়ে যেতে পারেনি।
বেশ কয়েকজন বিক্রয়কর্মী জানান, মেলায় শেষ দিন দর্শনার্থী কম হলেও বেচাকেনা ভালো হয়েছে। যারা স্টলে আসছেন তাদের প্রায় সবাই বই কিনেছেন। কেবল ঘুরতে আসা মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
মেলায় আসা লিমন ইসলাম লিটন বললেন, ‘শেষ দিন মেলায় এসেছি। প্রথম দিকে একবার এসেছিলাম। এখন শুধু তালিকা ধরে বই কিনেছি। এবারের মেলায় এখনও আগের ফিকশনগুলোই চলছে। তবে বইমেলা বেশ ভালো চলেছে বলে মনে হয়েছে।’
শব্দশৈলী প্রকাশনীর প্রকাশক ইফতেখার আমীন বলেন, ‘মেলার সময় বাড়ানোর কারণে বেশ ভালো বিক্রি হয়েছে। আজ (শনিবার) বই কেনেননি এমন ক্রেতা মেলায় চোখে পড়েনি। প্রবন্ধ, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাস্থ্যবিষয়ক ও বাচ্চাদের নৈতিকতার বই বেশি বেচাকেনা হয়েছে।’
৬০ লাখ দর্শনার্থীর মেলায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি
অনুপম প্রকাশনীর প্রকাশক মিলন কান্তি নাথ বলেন, ‘বইমেলার সময় বৃদ্ধি করায় বড় বড় প্রকাশনীগুলো লাভবান হয়েছে। আমাদের বেচাকেনা বেশ ভালোই হয়েছে। ক্রেতারা এসেছেন, বই কিনেছেন। এবারের বইমেলা বেশ ভালোভাবেই গেল।’
এদিকে অমর একুশে বইমেলার ৩১তম দিনে শনিবার মেলা শুরু হয় সকাল ১১টায় এবং চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। শেষ দিন মেলায় নতুন বই এসেছে ১৪৯টি।
বিকেল ৫টায় মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৪’-এর সদস্য সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলামের লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করেন একাডেমির উপ-পরিচালক ড. সাহেদ মন্তাজ।
সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। সম্মানিত অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বেগম নাহিদ ইজাহার খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ।
বক্তব্য দেন সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশ লিমিটেড-এর সিএমও মীর নওবত আলী।
সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
অনুষ্ঠানে সম্প্রতি বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
৬০ লাখ দর্শনার্থীর মেলায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘এবার ছিল অধিবর্ষের বইমেলা। নির্ধারিত ২৯ দিনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় অতিরিক্ত দুদিন যুক্ত হয়ে ৩১ দিনের দীর্ঘ বইমেলা শেষ হয়েছে। ২০২৪-এর বইমেলা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ছিল বিস্তৃত, ব্যাপক ও বর্ণাঢ্য।
‘শীতে শুরু হয়ে বইমেলা স্পর্শ করেছে বসন্ত-বাতাস। একুশের রক্তপলাশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মার্চের চেতনার রং।’
সদস্য সচিব তার প্রতিবেদনে বলেন, ‘মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এবারের বইমেলায় শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। বাংলা একাডেমি বিক্রি করেছে এক কোটি ৩৬ লাখ টাকার বই।’
ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, ‘অমর একুশে বইমেলা বাঙালির ভাষা, শিল্প-সাহিত্য ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বইমেলার মাধ্যমে প্রতিবছর আমরা আমাদের সৃজনশীলতাকে উদযাপন করি। এই মেলা আমাদের আবেগের, জাতিসত্তার, ভাষা-সাহিত্য ও ঐতিহ্যের প্রতি ভালোবাসার মেলা।
৬০ লাখ দর্শনার্থীর মেলায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি
বেগম নাহিদ ইজাহার খান বলেন, ‘বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। এই মেলা দেখতে দেখতে চার দশক অতিক্রম করে এখন বিশাল আকার ধারণ করেছে। বিশ্ব বাঙালির কাছে যেমন ঠিক তেমনই বিশ্বের জ্ঞানপিপাসু মানুষের কাছেও একুশের বইমেলা এক অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত।’
মীর নওবত আলী বলেন, ‘বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলার সঙ্গে সহযোগিতায় থাকতে পেরে বিকাশ লিমিটেড আনন্দিত ও গর্বিত।’
খলিল আহমদ বলেন, ‘অমর একুশে বইমেলা কেবল বই বিক্রির জায়গা নয়; দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রাণের মেলা। সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় এবারের মেলা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে।’
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনের এক অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনা। তথ্য-প্রযুক্তির বিপুল বিকাশের পরও মুদ্রিত বইয়ের আবেদন যে কোনোমতেই ফুরিয়ে যায়নি তার প্রমাণ একুশে বইমেলায় ক্রমবর্ধমান জনসমাগম।
৬০ লাখ দর্শনার্থীর মেলায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি
গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ প্রদান
অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশের জন্য কথাপ্রকাশ-কে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ দেয়া হয়।
২০২৩ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে শৈল্পিক ও গুণমান বিচারে সেরা বই বিভাগে মনজুর আহমদ রচিত ‘একুশ শতকে বাংলাদেশ: শিক্ষার রূপান্তর’ গ্রন্থের জন্য প্রথমা প্রকাশন, মঈন আহমেদ রচিত ‘যাত্রাতিহাস: বাংলার যাত্রাশিল্পের আদিঅন্ত’ গ্রন্থের জন্য ঐতিহ্য এবং আলমগীর সাত্তার রচিত ‘কিলো ফ্লাইট’ প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুকস-কে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ দেয়া হয়। ২০২৩ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ দেয়া হয় ময়ূরপঙ্খি-কে।
৬০ লাখ দর্শনার্থীর মেলায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি
এবারের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্যপ্রকাশ (প্যাভিলিয়ন), নিমফিয়া পাবলিকেশন (২-৪ ইউনিট) ও বেঙ্গল বুকস (১ ইউনিট)-কে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ দেয়া হয়।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলা একাডেমির পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. শাহাদাৎ হোসেন এবং উপ-পরিচালক সায়েরা হাবীব।