নেটিজেনদের রসিকতায় ভাইরাল সংলাপের বছর

অনলাইন ডেস্ক

নেটিজেনদের রসিকতায় ভাইরাল সংলাপের বছর। ২০২৪ সাল ছিল বেশ ঘটনাবহুল। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন থেকে গণঅভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ, আর শিক্ষার্থীদের দেশ পুনর্গঠনের প্রত্যয়—সব মিলিয়ে নানা জাতীয় ইস্যুতে সাধারণ মানুষ আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।

এসব ঘটনার প্রতিচ্ছবি উঠে আসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে, যেখানে নানা সংলাপ নিয়ে তুমুল চর্চা চলে। প্রেক্ষাপট মিলে গেলেই ব্যবহার করা হচ্ছে এসব সংলাপ। ভার্চুয়াল দুনিয়ার বাইরেও এসব সংলাপ স্থান করে নিচ্ছে মানুষের মুখে মুখে। এই প্রতিবেদনে আমরা ফিরে দেখব, ২০২৪ সালে ভাইরাল হওয়া কিছু আলোচিত সংলাপ।

নাটক কম করো পিও

‘নাটক কম করো পিও’ কুমিল্লার এক কিশোরের এই সংলাপ পুরো বাংলাদেশেই আলোচনার জন্ম দেয়। গণঅভ্যুত্থানের আগে থেকেই নেটিজেনরা এই সংলাপ ব্যবহার করছিলেন। পরে শেখ হাসিনার সঙ্গেও জুড়ে যায় এই সংলাপ। এ ছাড়া প্রেক্ষাপট মিলে গেলেই এই সংলাপ ব্যবহার করেন নেটিজেনরা।

একজন শিল্পীর আঁকা ‘নাটক কম করো পিও!’ শিরোনামের একটি কার্টুন যে কতটা জনপ্রিয়তা পায়, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুঁ মারলেই বোঝা যায়।

গত অক্টোবরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় ছাত্র আন্দোলন ঘিরে আঁকা গ্রাফিতি ঘুরে দেখেন। শেখ হাসিনার একটি কার্টুনের সঙ্গে লেখা ছিল ‘নাটক কম করো পিও। ’ এই গ্রাফিতি দেখে হাসছিলেন তিনি।

চালাইদেন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন পোস্ট মুহূর্তে ভাইরাল হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই অবশ্য জানা যায়, বিষয়টি সম্পূর্ণ গুজব। সেটি নিয়ে রাতভর ফেসবুক পোস্টে অনেকেই রসিকতা করেন। এক পর্যায়ে গত ৮ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদ ছেড়েছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে।

এ নিয়ে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সেখানে তিনি লেখেন, ‘শুধু চেয়ারই না, প্রধান উপদেষ্টাসহ দেশ ছাড়লেন বাকি উপদেষ্টারাও। সোর্স : চালাইদেন।’

নাইস অ্যান্ড অ্যাট্রাকটিভ

চলতি বছর সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে সাংবাদিক ও গায়িকা নবণীতা চৌধুরীর একটি ছবির নিচে ‘নাইস অ্যান্ড অ্যাট্রাকটিভ’ লিখে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। তার এই মন্তব্য অনলাইন-অফলাইন দুই মাধ্যমেই আলোচনায় ছিল। কারও সম্পর্কে ইতিবাচক কোনো মন্তব্য করতে গেলেই ‘নাইস অ্যান্ড অ্যাট্রাকটিভ’ জুড়ে দিতেন নেটিজেনরা।

মুরুব্বি মুরুব্বি, উহু উহু

একটি ওয়াজ মাহফিলে বয়ান দিচ্ছিলেন মাওলানা মোস্তাক ফয়েজী। হঠাৎ মাহফিল ছেড়ে একজন উঠে চলে যেতে চাইলে তিনি বয়ানের মাঝেই বলে ওঠেন, ‘মুরুব্বি, উহু উহু। ’ পরে এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর মোস্তাক ফয়েজীর ‘এই সোনামণি, বসো, উহু উহু’ সংলাপও নেটিজেনদের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়।

এই ওয়েট ওয়েট

দেশে কোটা আন্দোলনের সময় ভাইরাল হন শিক্ষার্থী ফারজানা সিঁথি। তার বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি বলার ধরন বেশ বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছিল নেটিজেনদের। এক সেনা সৈনিকের সঙ্গে তার বাক-বিতণ্ডার ভিডিও নেটপাদায় ভাইরাল হয়। সেখানে সেই সেনা সৈনিককে তিনি বলেন, এই ওয়েট ওয়েট, ইটস মাই টার্ন বলেন। এ ডায়ালগ টিকটকাররাও তাদের ভিডিও তৈরিতে বেশ লুফে নেন চলতি বছর।

আপনি রাবিশ কথা বলবেন না

এ বছরই নেটদুনিয়ায় ভাইরাল হয় মেট্রো টু দ্য পয়েন্ট নামের একটি অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্লিপ। যেখানে উপস্থাপিকা দীপ্তি চৌধুরী ও বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এক সময় বিচারপতি মানিক দীপ্তির উদ্দেশে বলেন, আপনি কথা বলবেন না। প্রতি উত্তরে দীপ্তি বলেন, আপনি প্লিজ উত্তেজিত হবেন না।

শেখ হাসিনা পালায় না

জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবর নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তিনি তখনো পালাননি। পরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের মধ্যে গুজব ছড়ানো হয়েছে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। কিন্তু বলে দিতে চাই, শেখ হাসিনা পালায়নি, পালায় না। ’

পরে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ সংলাপটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। গণঅভ্যুত্থানের সময়ে দেয়ালে দেয়ালেও তার এই সংলাপ লেখা হয়।

পালাব না, কোথায় পালাব

‘আমরা এই দেশে জন্মেছি, এই দেশে মরব, পালাব না। কোথায় পালাব! পালাব না, প্রয়োজনে ফখরুল সাহেবের বাসায় গিয়ে উঠব’—বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্দেশ্য করে এক সময় এ কথা বলেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

গণঅভ্যুত্থানের পর গা ঢাকা দিলে তার ‘পালাব না, কোথায় পালাব’ সংলাপটি বেশ আলোচনায় আসে। নেটিজেনদের অনেকেই তাকে মজা করে আরও কিছু নামেসম্বোধন করেন এবং এই সংলাপ জুড়ে দিয়ে প্রশ্ন রাখেন তিনি কোথায়।

আওয়ামী লীগের পতনের পর ওবায়দুল কাদেরের ‘শি হ্যাজ মেইড আস…’, ‘একটু অপেক্ষা করা যায় না, ‘বলব না, একটা শব্দও বলব না’, ‘মাসুদ তুমি কি কোনোদিনই ভালো হবে না’— সংলাপগুলোও দেয়ালে দেয়ালে দেখা যায়। আর সামাজিক মাধ্যমেও বেশ আলোচনায় চলে আসে।

হাউন আংকেল

গণঅভ্যুত্থান-পূর্ব বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচিত ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ। কেউ কোনো সমস্যায় পড়লেই তার শরণাপন্ন হতেন। এই ‘মুশকিলে আসান’ হারুনকে নিয়েও একটি সংলাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

চলতি বছর একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় উঠতি শিশু তারকা সিমরিন লুবাবা সাবেক ডিবি প্রধান হারুনকে ‘হাউন আঙ্কেল’ বলে সম্বোধন করে। এতে লুবাবা নেট দুনিয়ায় বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে। গণঅভ্যুত্থানের সময়ে হারুনকে অনেকটা ব্যঙ্গ করেই ‘হাউন আঙ্কেল’ বলতে থাকেন।

আবেগ কাজ করেছে, বিবেক কাজ করেনি

চট্টগ্রামে নৃশংস এক হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বেরিয়ে আসে, শ্বশুরকে খুন করেন তার পুত্রবধূ। হত্যায় জড়িত থাকার দায় স্বীকার করে গণমাধ্যমে তিনি বলছিলেন, ‘আমি দোষী, আমি কি আপনাদের একবারও বলেছি আমি নির্দোষ। তখন আমার আবেগ কাজ করেছে, বিবেক কাজ করেনি।’ তার এই আবেগ-বিবেক কাজ করার সংলাপও নেটিজেনদের মধ্যে বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল।

দোয়া করবেন ভাই, বোবা হয়ে আছি

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে দায়ের করা এক মামলায় আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় জুনাইদ আহমেদ পলককে। এ সময় প্রিজন ভ্যানে থাকাসাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন- কেমন আছেন? জবাবে প্রিজন ভ্যানের ভিতর থেকে পলক বলেন, ‘দোয়া করবেন ভাই, বোবা হয়ে আছি, বোবা।’

গত ১৭ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে বের হয়ে পুলিশি পাহারায় চুপচাপভাবে প্রিজনভ্যানে ওঠেন পলক। এরপর আরও কয়েকজনকে ওঠানো হয় সেই গাড়িতে। ভ্যানটি ছাড়ার পর ভেন্টিলেটর দিয়ে বাইরে তাকান সাবেক প্রতিমন্ত্রী। এ সময় তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে বলেন- ‘আপনারা মুক্ত আছেন তো? আমরা বোবা।’

রিয়েলিটি মাইনা নাও, বারোটা তোমার বেজে গেছে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের এ অংশটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের মন্ত্রীরা যখন ছাত্র-জনতার দাবি বুঝতে একদমই ব্যর্থ হয়ে পড়ে, ঠিক সে সময়টায় রসিকতার ছলে শেখ মুজিবের এ মন্তব্য ভাইরাল হয়।

সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেনি, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে

জুলাইয়ের প্রথম থেকে নানা দাবিতে ডানা বাঁধতে শুরু করে ছাত্র আন্দোলন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন যখন অভ্যুত্থানের দিকে মোড় নিতে থাকে, সে সময়টাতে অর্থাৎ ১৭ ও ১৮ জুলাই পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা হয় ইন্টারনেট সেবা।

তবে সে কথা স্বীকার করেনি তৎকালীন সরকার। পতিত সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক ২৭ জুলাই এক অনুষ্ঠানে বলেন, সরকার দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করেনি, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে।

তখন পলক বলেছিলেন, সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেনি। মহাখালীতে তিনটি ডেটা সেন্টারে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের (আইএসপি) ৭০ শতাংশ সার্ভার থাকে। দেশের ৩৪টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ের (আইআইজির) মধ্যে ১৮টির ডেটা এই তিনটি ডেটা সেন্টারে হোস্ট করা। দুই দিন পর তাঁরা জানতে পেরেছেন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের কাঁচপুরে সাবমেরিনের কিছু কেব্‌ল ওপরের দিকে ছিল, সেগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দেও

গ্রামের এক শিশুর ‘প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দেও’ সংলাপও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনায় ছিল। প্রেক্ষাপট মিলে গেলেই নেটিজেনরা সংলাপটি ব্যবহার করতেন। এই সংলাপ নিয়ে অনেকে টিকটক ভিডিও ও শর্টসও তৈরি করেন। এমনকি এটি নিয়ে ডিজে গানও তৈরি হয়।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি
বিষয়:
ফেসবুকফিরে দেখা ২০২৪

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত