দ্রব্যমূল্যের দাম লাগামহীন, রোজা ঘিরে ভোক্তার দুশ্চিন্তা বাড়ছেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

খেয়েপরে বেঁচে থাকতে প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন সাধারণ মানুষ। সকাল-বিকালের নাশতা থেকে শুরু করে তিন বেলার খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছেই। রান্নায় চুলা জ্বালাতে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার কিনতেও বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।

এমনকি সাবান-শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট সবকিছুর দাম আকাশছোঁয়া। কিন্তু বাড়েনি মানুষের আয়। এতে সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সব শ্রেণির মানুষ। এর মধ্যে আসছে পবিত্র রমজান।

ইতোমধ্যে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে রোজার পাঁচ পণ্য-ছোলা, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, খেজুরের দাম তিন মাস আগ থেকেই বাড়ানো হচ্ছে। এতে রোজা ঘিরে ভোক্তার দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে। সোমবার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

সোমবার রাজধানীর কাওরান বাজার, নয়াবাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজারসহ একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ দিন প্রতি কেজি দেশি রসুন ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর একই সময় ছিল ১৫০ টাকা।

দেশি হলুদ ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ২৪০ টাকা ছিল। প্রতি কেজি আমদানি করা হলুদ বিক্রি হচ্ছে ২৯০, যা আগে ২১০ টাকা ছিল। দেশি আদার কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০, যা গত বছর একই সময় ছিল ২০০ টাকা।

এদিন খুচরা বাজারের পণ্যমূল্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নভেম্বরে প্রতি কেজি চিনি ১৩৫ টাকা বিক্রি হলেও চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে ১৪০-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ভালোমানের মসুর ডাল নভেম্বরে বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা, ফেব্রুয়ারিতে তা ১৪০ টাকা।

প্রতি কেজি ছোলা নভেম্বরে বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা, ফেব্রুয়ারিতে ১১০ টাকা। ভোজ্যতেলের মধ্যে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল নভেম্বরে ১৫০ টাকা, ফেব্রুয়ারিতে দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা। বোতলজাত সয়াবিন তেল নভেম্বরে প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ১৬৮ টাকা, ফেব্রুয়ারিতে ১৭২ টাকা। প্রতি কেজি তিউনেশিয়ান খেজুর নভেম্বরে ৩০০ টাকা বিক্রি হলেও ফেব্র“য়ারিতে বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা।

এদিকে নভেম্বরে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১৩০ টাকা বিক্রি হয়। ফেব্রুয়ারির শুরুতে ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হলেও সোমবার সর্বোচ্চ ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা, আর নভেম্বরে দাম ছিল ১৮৫ টাকা।

পাশাপাশি নভেম্বর থেকে কমতে থাকে গরুর মাংসের দাম। সেসময় প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৭০০ টাকা। ডিসেম্বরে দাম কমে বিক্রি হয় ৫৫০-৬০০ টাকা। নির্বাচনের পর দাম কিছুটা বেড়ে ৬০০-৬৫০ টাকা হয়। এরপর ফেব্রুয়ারিতে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৭৫০ টাকা।

জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। নিত্যপণ্যসহ নিত্যব্যবহার্য সবকিছুর দাম বেড়েছে। ফলে আয় না বাড়লেও সব শ্রেণির মানুষের ব্যয় হুহু করে বাড়ছে। এর মধ্যে রোজার পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। তাই পণ্যের দাম যৌক্তিকভাবে বেড়েছে কি না, তা সংশ্লিষ্টদের দেখতে হবে। কোনো অনিয়ম পেলে অসাধুদের আইনের আওতায় এনে ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে হবে।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, যারা নিয়ম মোতাবেক ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ করে সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ হবে না, সেই আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের আমরা নীতিসহায়তা দিয়ে যাব। কিন্তু মজুতদারি করে যারা পণ্যমূল্য বাড়াচ্ছে, তাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়েছে। এটি অব্যাহত থাকবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) রিসার্স ফেলো ড. বদরুন নেছা আহমেদ জানান, বাংলাদেশে সাধারণত দাম একবার বাড়লে তা কমে আর আগের জায়গায় আসে না। উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, ২০১৩ সালে চাল ছিল প্রতি কোজি ৩৬ টাকা, সেটি ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ টাকায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরও বেড়ে হয়েছে ৮০-৮৫ টাকা।

একইভাবে দাম বেড়েছে মাংস, পোলট্রি মুরগি, সয়াবিন তেল, ডিমসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যেরই। এছাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রতিবছর ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ।

২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতির হার গণনা করা হয়েছিল ৯ দশমিক ০২ শতাংশ, যেখানে দশকের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার ছিল গত অক্টোবরে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এক্ষেত্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার আরও বেশি।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ঘুরে এবং বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বড় আকারের পাউরুটি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা, যা গত বছর ৮০-৮৫ টাকা ছিল। ৩০০ গ্রাম ওজনের প্যাকেট চানাচুর বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা, যা আগে ৭০ টাকা ছিল।

৮ পিসের প্যাকেট নুডলস বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা, যা আগে ছিল ১৪০ টাকা। এনার্জি বিস্কুটের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা, যা আগে ৩৫-৩৮ টাকা ছিল। ১০ টাকা বেড়ে পাইনাপেল বিস্কুটের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা। প্রতি কেজি টোস্ট বিস্কুট ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা। এদিকে ৮০ টাকায় বিক্রি হওয়া এক কেজির ওয়াশিং পাউডার এখন ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মানভেদে ২০০ গ্রাম ওজনের সব ব্র্যান্ডের টুথপেস্টে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। ২০০ গ্রাম ওজনের কোলগেট টুথপেস্টের দাম ১৩০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা।

কাওরান বাজারে কথা হয় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইমতিয়াজের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, পণ্যের বাড়তি খরচ বহন করে সংসার চালাতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। সবকিছুর ব্যয় বহন করে টিকে থাকা এখন যেন দায়। বাজারে এমন কোনো পণ্য পাওয়া যাবে না, যার দাম বাড়েনি। চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে সাবান, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট সবকিছুর দাম বাড়তি। এর মধ্যে আসছে রমজান মাস। ইতোমধ্যে ছোলা কেজিপ্রতি ২৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে শঙ্কা বাড়ছে। বাড়তি খচর বহন করে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে।

এদিকে ২০২৩ সালের বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খদ্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ পরিবার বর্তমানে উদ্বিগ্ন রয়েছে। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সীমিত বা নিম্ন-আয়োর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে এবং একই সঙ্গে জনসংখ্যার একটি অংশকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসতে বাধ্য করেছে। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত শ্রেণি পর্যন্ত।

পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারের নানা পদক্ষেপ যেমন বাজার মনিটরিং, ওএমএস, টিসিবির কার্ড দেওয়া ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ইত্যাদি সত্ত্বে বাজার নিয়ন্ত্রণহীন রয়েছে।

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত