কমিটি জটিলতায় দুর্বল খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

বিএনপি মনে করে, মাঠপর্যায়ের সংগঠনটিই দলটির আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি। কিন্তু নানা জটিলতায় ধীরে ধীরে তৃণমূল দুর্বল হয়ে পড়ায় আন্দোলন জোরালো হচ্ছে না।

দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার দাবিতে ১ জুলাই থেকে দেশের সব জেলা ও মহানগরে সমাবেশ করেছে বিএনপি। তিন দিনের এই কর্মসূচি বেশ গুরুত্ব দিয়ে তৃণমূলে নির্দেশনাও পাঠানো হয়। অথচ বেশ কয়েকটি জেলায় দলীয় বিরোধের জের ধরে কর্মসূচি জোরালোভাবে পালিত হয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই পক্ষগুলো আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছে। যে কারণে আন্দোলন যতটা জোরালো হওয়ার কথা, ততটা হচ্ছে না।

খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গত ২৯ জুন ঢাকায়, ১ জুলাই মহানগর ও ৩ জুলাই জেলা পর্যায়ে সমাবেশ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি।

বিএনপি মনে করে, মাঠপর্যায়ের সংগঠনটিই দলটির আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি। কিন্তু নানা জটিলতায় ধীরে ধীরে তৃণমূল দুর্বল হয়ে পড়ায় আন্দোলন জোরালো হচ্ছে না। যার প্রতিফলন দেখা গেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষিত এক দফা কর্মসূচিতেও।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ১০ জেলায় দলে বিরোধ রয়েছে। অন্তত ২০টি জেলায় কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতে থাকেন না কমিটির বাইরে থাকা নেতাকর্মীরা। যদিও তারাই আগে এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক হারে অংশ নিতেন। জানা গেছে, বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক জেলার কমিটিগুলো কার্যকর নয়। পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে মাত্র ১০ জেলায়।

বিএনপির দপ্তর সূত্র বলছে, তাদের কাছে জেলা কমিটির সম্পূর্ণ তথ্য নেই। গত বছরের ২৮ অক্টোবর সমাবেশ প- হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে জরুরি অনেক কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। গুলশানে চেয়ারপারসনের অফিস থেকে তথ্য এনে কাজ সারতে হচ্ছে। আর গুলশান অফিস সূত্র বলছে, সাধারণত কয়েক মাস পর পর পরিপূর্ণ তথ্য নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তাদের কাছে পাঠানো হয়।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি মাঠের রাজনীতিতে ফিরেছে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি ঘিরে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজধানীতে বড় ধরনের জমায়েত হয়। দ্বিতীয় দিনে সমাবেশ কর্মসূচি ছিল মহানগর পর্যায়ে। কেন্দ্র থেকে গুরুত্ব দিয়ে এই কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু ফরিদপুর জেলা বিএনপি তা পালন করেছে আলাদাভাবে।

কমিটি নিয়ে দুই বছর আগে ফরিদপুর বিএনপির রাজনীতিতে বিরোধ শুরু হয়। সর্বশেষ ১ জুলাই দুই ভাগে বিভক্ত জেলা ও মহানগর বিএনপি দলের চেয়ারপারসনের মুক্তির কর্মসূচিতেও একসঙ্গে হতে পারেনি। মহানগরের দায়িত্বে আছেন এএফএম কাইয়ুম জঙ্গী। তার পক্ষে জেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আফজাল হোসেন খান, সৈয়দ জুলফিকার হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, খন্দকার ফজলুল হক, মহানগর যুবদলের সভাপতি বেনজীর আহমেদ, জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন প্রমুখ। আর জেলা কমিটির আহ্বায়ক হলেন সৈয়দ মোদাররেছ আলী। তাকে সমর্থন দেন বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার মাশুকুর রহমান ও সেলিমুজ্জামান সেলিম। এরা দুই পক্ষ আলাদা কর্মসূচি পালন করেছে। জেলা আহ্বায়কের কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী। অন্য অংশের কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় কেউ ছিলেন না।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলা কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। দুদিন পর ১৭ এপ্রিল ঘোষিত কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি ঘোষণার দাবিতে বিএনপির একাংশ ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়। জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মনোনয়নপ্রত্যাশীরা প্রতিবাদ জানান। তখন থেকেই ফরিদপুর বিএনপিতে বিভেদ চরম আকার ধারণ করে। ২০২২ সালের ১২ নভেম্বর বিএনপির ফরিদপুর বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে বিরোধ কিছুটা স্থিমিত হলেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।

দ্বিধাবিভক্ত আরেকটি জেলা জয়পুরহাট। এই জেলার আহ্বায়ক কমিটি ২০২০ সালে গঠিত হয় মো. শামসুল হককে আহ্বায়ক করে। প্রথম আহ্বায়ক করা হয় মো. গুলজার হোসেনকে। শামসুল হক মারা যাওয়ায় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে গুলজার হোসেনকে আহ্বায়ক করা হয়। তিন মাসের জন্য গঠিত ওই আহ্বায়ক কমিটি এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ হয়নি। এই কমিটির পক্ষে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ওবায়দুর রহমান চন্দন। অপর পক্ষে রয়েছেন সাবেক দুই এমপি ফয়সল আলীম ও ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা। দুই পক্ষই খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে আলাদা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। দলীয় কার্যালয়ের সামনে এসে কর্মসূচি শেষ করেছে ফয়সল আলীম ও ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফার পক্ষ। সেখানে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল ওহাব, জেলা যুবদলের আহ্বায়ক শাহনেওয়াজ কবির শুভ্র, জেলা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলামসহ নেতারা ছিলেন। অন্য পক্ষও শহরে মিছিল করে এসে দলীয় কার্যালয়ের সামনে কর্মসূচি শেষ করে। সেখানে সমাবেশে বক্তব্য দেন বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহীন শওকত, সহসাংগঠনিক সম্পাদক ওবায়দুর রহমান চন্দন, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গুলজার হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ রানা প্রধান, পাঁচবিবি উপজেলার সভাপতি সাইফুল ইসলাম ডালিম প্রমুখ।

২০১৯ সালে সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমীকে আহ্বায়ক ও অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দীনকে সদস্য সচিব করে কুষ্টিয়া জেলা কমিটি গঠিত হয়। পরে এই কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হলেও এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সকালে জেলা বিএনপির কার্যালয়ে মেহেদী আহমেদ রুমীর সভাপতিত্বে সমাবেশ হয়। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সামসুজ্জামান দুদু। আর অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দীন পক্ষ সন্ধ্যায় একই স্থানে সমাবেশ করে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি বসিরুল আমল চাঁদের সভাপতিত্বে জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক শামিম উল হাসানসহ স্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

একই অবস্থা রাজবাড়ী জেলা বিএনপিতে। দুটি পক্ষ একই কর্মসূচি পৃথকভাবে পালন করেছে। এক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন বর্তমান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী, সাবেক সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আসলাম ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ। জেলা বিএনপি কার্যালয় এদের দখলে। ৩ জুলাই জেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে তাদের সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. সুকোমল বড়ুয়া। অপর পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন রাজবাড়ী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম, রাজবাড়ী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নাসিরুল হক সাবু। এই পক্ষ আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মের বাসভবনে তাদের কর্মসূচি পালন করেছে।

জানা যায়, আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মকে সভাপতি ও হারুন অর রশীদকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট জেলা কমিটি ভেঙে ২০১৯ সালে জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা লিয়াকত আলীকে আহ্বায়ক এবং অধ্যক্ষ মঞ্জুরুল আলম দুলালকে সদস্য সচিব করার মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্বের শুরু। ২০২১ সালে অধ্যক্ষ মঞ্জুরুল আলম দুলালকে সদস্য সচিবের পদ থেকে সরিয়ে কামরুল আলমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে জেলা বিএনপি।

মৌলভীবাজার জেলা বিএনপিরও একই অবস্থা। একাংশের অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা সভাপতি ও সাবেক এমপি এম নাসের রহমান, অপর অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান। আলাদা কর্মসূচি পালনের মধ্যে রয়েছে বান্দরবান, চাঁদপুরসহ আরও কয়েকটি জেলা।

মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্তত ২০ জেলায় এক অংশ মাঠের কোনো কর্মসূচিতেই থাকে না। যেমন খুলনায় মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু অনুসারীরা কোণঠাসা থাকায় দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নেন না। পুরো জেলা ও মহানগরে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে মহানগর ও জেলা বিএনপির বর্তমান নেতারা। মুন্সীগঞ্জে অঘোষিতভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শ্রীনগর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ আব্দুল্লাহ। এই গার্মেন্টস ব্যবসায়ী দলীয় কর্মকা-ে না থাকলেও জেলা বিএনপিতে তার বেশ দাপট। ফলে জেলার পোড় খাওয়া নেতা আব্দুল হাই, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ধীরেন কুদ্দুসসহ আগের কমিটির কেউই কর্মসূচিতে অংশ নেন না। তারা অংশ নিতে চাইলেও শেখ আব্দুল্লাহর ইশারায় যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয় না। ফলে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় এই নেতারা। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ অন্তত ২০টি সাংগঠনিক জেলায় কর্মসূচি পালনে এমন শৈথিল্য দেখা গেছে।

এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘অতিদ্রুত নিজেদের ভুল-বোঝাবুঝি, বিভেদগুলো দূর করে, একত্র ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা একটা কঠিন সময় অতিক্রম করছি। তাই নিজের শক্তির ওপর নির্ভর করে সরকারকে বাধ্য করতে হবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৮২টি সাংগঠনিক জেলা কমিটির মধ্যে ৩১টিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মেয়াদ আছে মাত্র ১০টি জেলার। আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে ৫১টিতে। এর মধ্যে নীলফামারী, হবিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নওগাঁ, যশোর, বগুড়া, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, সৈয়দপুর, রাজশাহী, নেত্রকোনা, পঞ্চগড়, ঝিনাইদহ, মাগুরাসহ কয়েকটি কমিটির কোনোটার ৩ মাসের মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে, কোনোটার শেষ হওয়ার পথে।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি পুরোদমে দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু করলেও ২০২০ সালে করোনা মহামারীর কারণে থমকে যায়। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডও স্থগিত রাখা হয়েছিল। ওই উদ্যোগের পর মাত্র ২০টির মতো জেলা কমিটির সম্মেলন হয়েছিল। পরে আর পুনর্গঠন কাজ শুরু করতে পারেনি দলটি।

বিএনপির একাধিক নেতার মতে, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন পর্যন্ত আন্দোলন মূল্যায়ন করে ইতিমধ্যে সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকরা হাইকমান্ডকে প্রতিবেদন দিয়েছেন। সেখানে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় জেলাসহ ইউনিটের শীর্ষ নেতাদের কার কোথায় কী ভূমিকা ছিল, সেটা তুলে ধরা হয়েছে। সেই আলোকে জেলা কমিটিগুলো নতুন করে পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।

জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^র চন্দ্র রায় বলেন, ‘কমিটি পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। সাংগঠনিক প্রয়োজনেই রদবদল করা হয়। বিশেষ করে সংগঠনে প্রত্যেকের একটা জবাবদিহি করতে হয়। যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি সেটা সঠিকভাবে পালন না করলে সে ক্ষেত্রে যিনি ভালো করতে পারবেন, তাকেই দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এবার সেটাই হচ্ছে।’

সোস্যাল নেটওয়ার্ক

সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত