দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে চিনির দাম ইতোমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। প্রতি মণ চিনিতে দাম বেড়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। বন্দর নগরীর খুচরা বাজারগুলোতেও পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার ইছানগরে এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলে অগ্নিকাণ্ডের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে চিনির বাজারে। আগুন লাগার কারণে বাজারে চিনির সরবরাহ ও দামে কোনো সমস্যা হবে না বলে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জানালেও বাস্তব চিত্র উল্টো।
দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে চিনির দাম ইতোমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। পবিত্র রমজান শুরুর আগের এই সময়টাতে প্রতি মণ চিনিতে দাম বেড়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। বন্দর নগরীর খুচরা বাজারগুলোতেও পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলে আগুনে এক লাখ টন অপরিশোধিত চিনি পুড়ে গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে সেগুলো পরিশোধিত হয়ে বাজারে আসতে সময় লাগত। এর মধ্যে দিনে দিনে চিনির দাম বাড়াটা অযৌক্তিক।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলে অগ্নিকাণ্ডকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন ঢাকার মিল মালিকরা। তারা বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। আর এর প্রভাব পড়ছে ভোক্তা পর্যায়ে।
খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুধবার ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা চিনি বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৭৫০ টাকায়। একদিন আগে অর্থাৎ সোমবার বাজারটিতে চিনি বিক্রি হয় ৬ হাজার ৬৮০ টাকা মণ। মঙ্গল ও বুধবার দুদিনেই বস্তাপ্রতি চিনির দাম বেড়েছে ৭০ টাকা।
একইভাবে খুচরা বাজারেও চিনির দাম কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। সোমবার প্রতি কেজি চিনি ১৪২ টাকায় বিক্রি হলেও বুধবার তা বিক্রি হয় ১৪৫ থেকে ১৪৬ টাকায়।
অথচ বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বুধবার বলেন, ‘এস আলম গ্রুপের চিনিকলে অগ্নিকাণ্ডে চিনির সরবরাহ ও দামে কোনো প্রভাব পড়বে না।
বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা আগুনে কী পরিমাণ চিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা প্রাথমিকভাবে নিরূপণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। এই পরিমাণটা ২০ থেকে ৩০ হাজার টনের মধ্যে হবে।’
তিনি বলেন, ‘রমজানে প্রায় ৩ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। কারখানায় আগুনে পুড়ে যাওয়া চিনির পরিমাণ সেই চাহিদার ১০ শতাংশেরও কম। এ ঘটনায় চিনির বাজার দরে কোনো প্রভাব পড়বে না।’
এস আলম গ্রুপও জানিয়েছিল যে তাদের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের প্রভাব বাজারে পড়বে না। গুদামে আগুন লেগে এক লাখ টন অপরিশোধিত চিনি পুড়ে যাওয়ার কথা বললেও রোজা সামনে রেখে চিনির বাজারে পণ্যটির সরবরাহে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছিল তারা।
মঙ্গলবার দুপুরে পুড়ে যাওয়া গোডাউন দেখতে এসে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ড্রাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগুনে গুদামের ক্ষতি হলেও কারখানার কোনো ক্ষতি হয়নি। ফলে দু-একদিনের মধ্যে উৎপাদন শুরু করা যাবে। এখনও পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। রমজানের চাহিদা মেটানোর মতো চিনি মজুত আছে। দাম বাড়ার কোনো আশঙ্কা নেই।’
একই দিন দুপুরে এস আলম গ্রুপের জিএম (কমার্শিয়াল) মো. আকতার হাসান বলেন, ‘আগুনে আমাদের ক্ষতি কত তা এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে নিশ্চিত করতে পারি, বাজারে কোনো প্রভাব পড়বে না। এখনও বাজারে ১০-১৫ দিন সরবরাহ করার মতো ফিনিশড (পরিশোধিত) চিনি আমাদের হাতে আছে।’
বাস্তবতা হলো, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী এবং এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য দেয়া হলেও বাজারে চিনির দাম বেড়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তারা কোনো একটি অজুহাত পেলেই দাম বাড়িয়ে দিত। এখন তারা অজুহাত হিসেবে আগুনের ঘটনাকে সামনে এনে চিনির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ গুদামে যেসব চিনি ছিল সেগুলো অপরিশোধিত।’
রোববার বিকেল পৌনে ৩টার দিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার ইছানগর এলাকায় এস আলম সুগার রিফাইন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানায় আগুন লাগে। চিনির কাঁচামালের গোডাউন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনে প্রায় এক লাখ টন ‘র’ চিনি পুড়ে গেছে বলে দাবি করেছে এস আলম গ্রুপ। দুদিন অতিবাহিত হলেও বুধবারও মিলের ১ নম্বর গোডাউনের আগুন নেভানো যায়নি। বর্তমানে কারখানায় চিনি পরিশোধন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, দেশে বছরে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন পরিশোধিত চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো থেকে আসে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টনের মতো। অবশিষ্ট চিনি আমদানি করা হয়।
সে হিসাবে দেশের চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ চিনি আমদানি করতে হয়। দেশে ব্যক্তি খাতের পাঁচ শিল্প গ্রুপ সিটি, মেঘনা, এস আলম, আবদুল মোনেম লিমিটেড ও দেশবন্ধু সুগার মিল অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। পরে নিজেদের মিলে পরিশোধন করে এসব চিনি বাজারজাত করা হয়।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এস আলম গ্রুপের মিলে আগুন একটি দুর্ঘটনা। এটাকে পুঁজি করে ঢাকার মিল মালিকরা চিনির দাম বাড়াচ্ছেন। বড় মিল মালিকরা সরবরাহ কমিয়ে সংকট তৈরি করলে পাইকারি কিংবা খুচরা উভয় বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এস আলম সুগার মিলে আগুন লাগার ঘটনার পর চিনির দাম কিছুটা বেড়েছে। প্রতি মণে ২০ টাকা বেড়েছে। দুদিন আগে এস আলমের রেডি চিনি বিক্রি হয়েছে মণপ্রতি পাঁচ হাজার ৫০ টাকা। সোমবার তা ছিল প্রতি মণ ৪ হাজার ৯৭০ টাকা। একইভাবে অন্যান্য চিনির দামও একই হারে বেড়েছে।’
খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ও চিনির বড় ব্যবসায়ী আর এম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, ‘এস আলম সুগার মিলে আগুন লেগে অপরিশোধিত চিনি পুড়লেও অন্য মিলগুলোতে চিনির সংকট হওয়ার কথা নয়। সব মিলেই চিনি রয়েছে। কিন্তু এই অগ্নিকাণ্ডের অনৈতিক সুযোগ নিচ্ছে ঢাকার মিলগুলো। তারাই সরবরাহ কমিয়ে বাজারে সংকট তৈরি করছে।
‘খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে বা কমাতে পারেন না। মূলত ঢাকার মিলাররা দাম বাড়িয়ে দিলে খাতুনগঞ্জেও দাম বাড়ে।’
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘আগুনের ঘটনার পর থেকেই চিনির ডিও ব্যবসায়ীরা লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে পণ্যটির দাম মণপ্রতি ৫০ থেকে ৭০ টাকা বেড়েছে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, রমজানকে সামনে রেখে গত দুই মাসে চিনির আমদানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৬ শতাংশ বেড়েছে। এ দুই মাসে চিনি আমদানি হয়েছে ৪ দশমিক ৭৪ লাখ টন। গত বছরের একই সময়ে তা ছিল ৩ দশমিক ২৭ লাখ টন।
গত দু’মাসে আমদানি হওয়া ৪ দশমিক ৭৪ লাখ টন চিনির মধ্যে এস আলম গ্রুপ আমদানি করেছে ১ দশমিক ১২ লাখ টন। এ ছাড়া সিটি গ্রুপ ১ দশমিক ৬১ লাখ টন, মেঘনা গ্রুপ ১ দশমিক ৫৬ লাখ টন, আবদুল মোনেম গ্রুপ ২১ হাজার ৫০০ টন এবং দেশবন্ধু গ্রুপ ২০ হাজার ৫৯৫ টন আমদানি করেছে।