সরকার পতনের এক দফা দাবিতে গত বছরের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ কর্মসূচির ডাক দেয় বিএনপি। পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে সেই সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। তবে সমাবেশ শুরুর আগেই প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। গাছের ডাল ভেঙে ও হাতের লাঠি দিয়ে বাসভবনের নামফলক এবং গেটে ভাঙচুর করা হয়।
এ ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন আদালত। একই সময়ে হওয়া অন্য মামলাগুলোতে জামিন পেলেও এই একটি মামলায় জামিন না পাওয়ায় কারামুক্ত হতে পারছেন না বিএনপির এ দুই শীর্ষ নেতা।
রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলছেন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনার সঙ্গে বিএনপির এই নেতারা জড়িত নন। আদালত চাইলে তাদের জামিন দিতে পারেন।
২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ ঘিরে হামলা, ভাঙচুর, সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়। এর মধ্যে পল্টন থানায় আটটি ও রমনা মডেল থানায় তিনটি । বর্তমানে তিনি কারাগারে। তবে এই ১১ মামলার মধ্যে ১০টিতেই তার জামিন মঞ্জুর করেন বিচারিক আদালত। শুধু প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় জামিন আবেদন খারিজ করেন হাইকোর্ট। এ মামলায় আসামিপক্ষ আপিল করবে কি না- তা নিয়েই চলছে পরামর্শ।
গত ২৯ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে গুলশানের বাসা থেকে মির্জা ফখরুলকে আটক করে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় ওইদিনই গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষ জামিন চেয়ে আবেদন করে। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিনের আদালত ফখরুলকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলছেন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনার সঙ্গে বিএনপির এই নেতারা জড়িত নন। আদালত চাইলে তাদের জামিন দিতে পারেন।
এ মামলায় গত ২২ নভেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মির্জা ফখরুলের জামিন আবেদন নামঞ্জুর হয়। এরপর জামিন চেয়ে গত ৩ ডিসেম্বর হাইকোর্টে আবেদন করেন তিনি। আবেদনের শুনানি নিয়ে ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট জামিন প্রশ্নে রুল দেন। এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ১০ জানুয়ারি হাইকোর্ট জামিন প্রশ্নে রুল খারিজ করলে জামিনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় বিএনপির এ নেতার। রুল খারিজের রায়ে ওইদিন আদালত বলেন, অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে এ মুহূর্তে (ফখরুলকে) জামিন দেওয়া হলে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যে কারণে এ মুহূর্তে তাকে জামিন দেওয়া সমীচীন হবে না। তাই রুল খারিজ করা হলো। এর আগে গত ১৮ ডিসেম্বর পল্টন মডেল থানার মামলায় গ্রেফতার দেখানোর পর জামিন নামঞ্জুর করে ফখরুলকে কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে।
গত ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ ঘিরে হামলা, ভাঙচুর, সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মোট ১০টি মামলা হয়। গত ২ নভেম্বর দিনগত রাত পৌনে ১টার দিকে গুলশানের ৮১ নম্বর রোডের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
এরপর পল্টন থানার দুই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে। ওই দুই মামলায় গত ১৭ জানুয়ারি তার জামিন মঞ্জুর করেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হক। এরপর ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন ছয়টি মামলায় ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় আমীর খসরুর জামিন মঞ্জুর করেন।
রুল খারিজ করলে জামিনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় বিএনপির এ নেতার। রুল খারিজের রায়ে ওইদিন আদালত বলেন, অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে এ মুহূর্তে (ফখরুলকে) জামিন দেওয়া হলে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যে কারণে এ মুহূর্তে তাকে জামিন দেওয়া সমীচীন হবে না।
সর্বশেষ বুধবার (২৪ জানুয়ারি) পল্টন থানার নাশকতা মামলা ও রমনা থানায় প্রধান বিচারপতির বাসায় হামলার ঘটনায় করা মামলায় জামিন শুনানির দিন ধার্য ছিল। এদিন পল্টন থানার নাশকতার মামলায় আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন। তবে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় আমীর খসরুর জামিন নামঞ্জুর করেন আদালত।
এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বলেন, আটকের পর বিএনপি মহাসচিবকে ১১ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এরমধ্যে তাকে ১০ মামলায় জামিন মঞ্জুর করেছেন বিচারিক আদালত। তবে, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় তার জামিন আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। এ মামলায় চেম্বার জজ আদালতে নাকি নিম্ন আদালতে জামিন আবেদন করবো এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করবো।
তিনি বলেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মোট ১০টি মামলা হয়। এর মধ্যে ৯টি মামলায় তার জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। তবে, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা মামলায় তার জামিন নামঞ্জুর করেছেন আদালত। আমরা জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে তার জামিন আবেদন করবো।
এ আইনজীবী আরও বলেন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় করা মামলায় মির্জা ফখরুলকে আসামি করা হয়েছে। তিনি ঘটনার সময় নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে সমাবেশে ছিলেন। তিনি কোনোভাবেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। আশাকরি, আদালত এ মামলায়ও তার জামিন মঞ্জুর করবেন।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল জাগো নিউজকে বলেন, মির্জা ফখরুল ও আমীর খসরুর মামলায় জামিন শুনানিতে আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জামিনের বিরোধিতা করছি। আদালত সন্তুষ্ট হয়ে তাদের জামিন মঞ্জুর করছেন।
প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে একটি মামলার রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ওই মামলায় মির্জা ফখরুলের জামিন আবেদনের রায়ের পূর্ণাঙ্গ পাঠে বিচারপতি মো. সেলিম ও বিচারপতি শাহেদ নুরুদ্দিনের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১৫ জানুয়ারি এ পর্যবেক্ষণ দেন।
হাইকোর্ট বলেন, আবেদনকারী (ফখরুল) ওই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী বা তার কোনো ভূমিকা ছিল কি না- তা সুষ্ঠু তদন্তের পরই সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তবে এ পর্যায়ে তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হলে তা সুষ্ঠু তদন্তের জন্য অনুকূল হবে না।
রায়ে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি প্রজাতন্ত্রের তিনটি অঙ্গের একটির প্রধান। তাই প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে আমরা মনে করি।
ঘটনা পর্যালোচনা করে পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরও বলা হয়, অভিযুক্ত আবেদনকারী (মির্জা ফখরুল) দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করছেন, যাকে তিনি জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলন দাবি করে আসছেন। দুর্ভাগ্যবশত, বিগত কয়েক মাসে দেখা গেছে যে কথিত ওই ভোটাধিকারের দাবি দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে যুক্ত হয়েছে। যাতে প্রাণহানি, অগ্নিসংযোগ, হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনকারী সরকারি ও ব্যক্তিগত যানবাহন, পুলিশের গাড়িতে হামলার মতো ঘটনা রয়েছে।
আদালত বলেছেন, কথিত আন্দোলনকারীরাই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। আমরা এসব অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা বিবেচনায় নিয়েছি, যেগুলো দৃশ্যত দেশে আতঙ্ক তৈরি করেছে। বস্তুত দেশ ও দেশের জনগণকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
রায়ে আদালত আরও বলেন, আবেদনকারী বিপর্যয়কর ও উচ্ছৃঙ্খল এসব ঘটনার পরিকল্পনাকারী বা তার কোনো ভূমিকা ছিল কি না, সে বিষয়ে কেবল সুষ্ঠু তদন্তের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তদন্তের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে এই পর্যায়ে তার মুক্তির জন্য জামিন দেওয়া সহায়ক হবে না বলে আমরা মনে করছি। (মামলায়) কিছু ধারা আছে যা জামিন অযোগ্য। প্রজাতন্ত্র ও জনগণের নিরাপত্তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা রুলটি খারিজ করছি।
২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ শুরুর আগে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে গাছের ডাল ভেঙে ও হাতের লাঠি দিয়ে নামফলক, গেটে হামলা চালানো হয়। আসামিরা ভেতরে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। এ ঘটনায় মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির ৫৯ নেতার বিরুদ্ধে রমনা থানায় একটি মামলা করা হয়।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ শুরুর আগে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে গাছের ডাল ভেঙে ও হাতের লাঠি দিয়ে নামফলক, গেটে হামলা চালানো হয়। আসামিরা ভেতরে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। এ ঘটনায় মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির ৫৯ নেতার বিরুদ্ধে রমনা থানায় একটি মামলা করা হয়।
ফখরুল-খসরু ছাড়াও এ মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু, আব্দুল আওয়াল মিন্টু, আহমেদ খান, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবদিন ফারুক, নিতাই রায় চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, ভিপি জয়নাল, মহানগর উত্তর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ফরহাদ হালিম ডোনার ও সদস্যসচিব আমিনুল হক।
এদিকে, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলাসহ পৃথক ছয়টি মামলায় বিএনপির আরেক প্রভাবশালী নেতা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের আগাম জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ২৫ মার্চ পর্যন্ত জামিন দিয়ে এরপর সংশ্লিষ্ট সেশন কোর্টে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গত সোমবার (২২ জানুয়ারি) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. হাবিবুল গণি ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।