পপসম্রাট হিসেবে দেশের কোটি মানুষের মন জয় করেছিলেন যে আজম খান, মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা। দুঃসাহসিক কিছু গেরিলা অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে। তিনি ছিলেন সাদেক হোসেন খোকার (ঢাকার সাবেক মেয়র) গেরিলা প্লাটুনের সদস্য। এই প্লাটুনের আরেক যোদ্ধা কে এ জাহিদ জিন্নাহর স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করে খোকা, আজম খানসহ অন্য সহযোদ্ধাদের স্মৃতি।
জানা যায়, আজম খান ছিলেন দুঃসাহসিক এক তরুণ, যে কনোকিছুকেই পরোয়া করতেন না। সাহসী আজম খানের গল্প যেন রূপকথার মতোই লাগে, মতিঝিল, আরামবাগ, কমলাপুর, ফকিরাপুল, শাহজাহানপুর এলাকায় চায়ের দোকানে এখনো আজম খানের গল্প শোনা যায়। পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন আগরতলা। প্রশিক্ষণ নিতে।
প্রশিক্ষণ শেষে প্রথমে যোগ দেন সম্মুখ যুদ্ধে। বিখ্যাত হালদা যুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তারপর আবার তাঁকে আগরতলায় ডেকে পাঠানো হয়। খালেদ মোশাররফের অধীনে ২ নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের কমান্ডার করে আজম খানকে দেওয়া হয় ঢাকা শহরে গেরিলা অপারেশনের দায়িত্বে।
যাত্রাবাড়ী-গুলশান এলাকায় গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করতে থাকেন একের পর এক। আজম খানের মুক্তিযুদ্ধে সাহসী অবদান সম্পর্কে কালের কণ্ঠের সাথে এক সাক্ষাৎকারে সহযোদ্ধা মতিঝিল কলোনি সংলগ্ন টিঅ্যান্ডটি নাইট কলেজের ছাত্র জিন্নাহ।
তিনি বলেন, ‘তখন বর্ষাকাল। সিদ্ধান্ত হলো তিতাস গ্যাসের লাইনটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ঢাকা শহরে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে। এতে ঢাকা শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হবে।
ঠিক করা হলো, জাতির উদ্দেশে ইয়াহিয়া খান যখন ভাষণ দেবেন তখন অপারেশন চালানো হবে। আজম খানের নেতৃত্বে সাতজনের দল তৈরি হলো। আমিসহ সেই দলে আরো ছিলেন নূরুল আমিন, চট্টগ্রামের খোরশেদ, স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান খান, হাবিবুর রহমান হাবিব। নির্ধারিত সময়ে ডেমরার আমুলিয়া ও মাতুয়াইলের মাঝামাঝি বাউনি মিলের কাছে তিতাস গ্যাসের পাইপলাইনের ওপর অবস্থান নেন ছয়জন গেরিলা। কোদাল-শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে পাইপে এক্সপ্লোসিভ লাগানো হলো। এরপর চূড়ান্ত মুহূর্ত।’
তিনি বলেন, ‘ইয়াহিয়া খানের ভাষণের ঠিক আধঘণ্টা আগে ২০ ফুট দূরে গিয়ে ফিউজ ওয়ারে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো। এত বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হলো যে আমরাও মাটি থেকে ওপরের দিকে ছিটকে পড়লাম। গ্যাসে আগুন লেগে গোটা এলাকা আলোকিত হয়ে গেল। ডেমরায় ছিল পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান। তারাও বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। কোনো কিছু বুঝে উঠতে না পারায় তারা গোলাগুলি করতে পারেনি। একটি সফল অপারেশন সম্পন্ন করে আমরা নৌকা নিয়ে চলে এলাম। এ অপারেশনের কারণে ঢাকায় তিন-চার দিন গ্যাস সংযোগ ছিল না।’
গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, পূর্বাণী প্রভৃতির গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সেগুলোতে অবস্থানরত বিদেশিদের জানিয়ে দেন বাংলাদেশে কোনো ’গণ্ডগোল’ না, ’মুক্তিযুদ্ধ’ চলছে।
মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে আবারো সম্মুখ যুদ্ধ হয় আজম খানের নেতৃত্বাধীন গেরিলা ইউনিটের। জয়ী হয়ে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আজম খান ঢাকায় প্রবেশ করেন।
বাংলাদেশের পপসংগীতের কিংবদন্তি আজম খানের ৭৪তম জন্মদিন আজ। মনে পড়ে যায় এই যোদ্ধাকে, এই পপ সম্রাটকে। কেননা এদেশের কোটি ভক্ত হৃদয়ের খুব গভীর থেকে অনুভব করেন, শ্রদ্ধা করেন পপ আজম খানকে। কেননা মুক্তিযুদ্ধ যেমন নিয়ে এসেছেন সাহসিকতার পরিচয়ে, তেমনই পপ সঙ্গীতকে আলো ঝলমলে রেস্তোরাঁ থেকে বাইরে এনে জনসাধারণের করে তুলেছেন এই সুরস্রষ্টা।