‘মরি হায়রে হায় দুঃখে পরাণ যায়; হাজার টাকার বাগান খাইলো পাঁচ সিকার ছাগলে।’ তবে এবার আর পাঁচ সিকার ছাগল নয়; সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের হাজার কোটি টাকার সম্পদ খেল ১৫ লাখ টাকার ছাগলে। চাকরি জীবনের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে ছাগলকাণ্ডে ফেঁসে গেছেন প্রভাবশালী এই সরকারি কর্মকর্তা। কোরবানির জন্য ১৫ লাখ টাকায় ছেলের কেনা ছাগল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে বাবার পরিচয়ে টান পড়ে। আর তখনই বেরিয়ে আসে মতিউরের নামে-বেনামে গড়া সম্পদের পাহাড়।
কর ফাঁকির সুবিধা দিয়ে দেশের নামি-দামি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের সঙ্গে ব্যবসায়িক কানেকশন গড়ে তোলেন তিনি। ট্রেড ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়েও সুকৌশলে কাস্টমস ক্যাডারে প্রবেশ, এলসি জালিয়াতি, বন্ড সুবিধায় আনা পণ্য খোলা বাজারে বিক্রিসহ নানা অপকীর্তির বিস্তর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। সব সরকারের আমলেই অবৈধ অর্থের প্রভাবে পেয়েছেন রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়। বাগিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং। রাজস্ব আয় বাড়ানোর গুরু দায়িত্বে থেকে সরকারকে রাজস্ববঞ্চিত করে গুছিয়েছেন নিজের আখের।
কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের প্রায় সবই গড়েছেন স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের নামে। সব মিলে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। কিনেছেন দামি গাড়ি, বাড়ি। এ কর্মকর্তা হাতে পরেন ৩১ লাখ টাকার বেশি দামের রোলেক্স ঘড়ি। এরই মধ্যে মতিউর রহমানের প্রায় ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের হদিস মিলেছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই অন্তত দুই ডজন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তান ও ঘনিষ্ঠদের নামে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাহাবুদ্দিন পার্কের পাশে ৮৩ নম্বর রোডের ১১ নম্বর প্লটে আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের বেগ পার্ক ভিউতে রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। সেখানেই প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান লায়লা কানিজকে নিয়ে সপরিবারে বাস করতেন। দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার থাকেন লালমাটিয়ার ৮ নম্বর রোডের ৪১/২ ইম্পেরিয়াল ভবনে। কাকরাইলেও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে ছোট স্ত্রীর নামে। এ ছাড়া ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে একাধিক ফ্ল্যাটের হদিস পাওয়া গেছে।
বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ডেভেলপার কোম্পানি শান্তা ডেভেলপারের করা বিভিন্ন ভবনে তার আটটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব ফ্ল্যাট প্রথম স্ত্রীর সন্তান ফারজানা রহমান ঈপ্সিতা ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে কেনা হয়েছে।
এ ছাড়া গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট-প্লট, রিসোর্ট রয়েছে। মতিউর সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে এফডিআর ও শেয়ারবাজারে নিজ নামে অর্ধশত কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে বলেও জানা গেছে।
আইনগত ঝামেলা এড়াতে নিজের স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনের নামে সম্পদ গড়েছেন মতিউর রহমান।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ছাগলকাণ্ডে আলোচিত পুত্রকেও কিনে দিয়েছিলেন প্রাডো, প্রিমিও ও ক্রাউনের মতো চারটি বিলাসবহুল গাড়ি। এসব গাড়ি তার বিভিন্ন কম্পানির নামে রেজিস্ট্রেশন করা। কিনে দিয়েছেন দামি পাখিও। তার পরিচিত কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, বেনামে এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।
টঙ্গীতে ৪০ হাজার বর্গফুটের এসকে ট্রিমস নামের ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও অ্যাকসেসরিজ কারখানা রয়েছে তার। যদিও কাগজে-কলমে কারখানার মালিক তার ভাই এম এ কাইয়ুম হাওলাদার। ময়মনসিংহের ভালুকায় ৩০০ বিঘা জমিতে গ্লোবাল শুজ নামের দুটি জুতা তৈরির কারখানা রয়েছে। নরসিংদীর রায়পুরায় ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট রয়েছে। এসব রিসোর্টের মালিকানায় আছেন তার ছেলে ও মেয়ে। এ ছাড়া পূর্বাচলে আপন ভুবন পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পটের মালিকও তিনি।
গাজীপুর সদর এলাকায় ৭টি জায়গায় তার জমির খোঁজ মিলেছে। এ ছাড়া সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১২.৫৮ শতাংশ জমির খোঁজ পাওয়া গেছে। এই আট জায়গায় রয়েছে তার ৬০ শতাংশ জমি। স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১৪.০৩ শতাংশ, গাজীপুরে ৪৮.১৬ ও ১৪.৫০ শতাংশ এবং ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে ০.৪৫১৬২৫ একর জমি রয়েছে।
আর এসব ঘটনা সামনে আসতেই গতকাল রবিবার তিনি এনবিআর ও সোনালী ব্যাংকের পদ হারান। আর আজ সোমবার মতিউর রহমান, তার স্ত্রী লায়লা কানিজ ও ছেলে আহম্মেদ তৌফিকুর রহমান অর্নবের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
কিন্তু এর আগেই গতকাল রবিবার বিকেলের দিকে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে মাখা ন্যাড়া করে মতিউর পালিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ একাধিক কাস্টমস কর্মকর্তা। আর তার আগেই গত বুধবার (১৯ জুন) মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলী, ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত ও ইরফান দেশত্যাগ করে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। আর এই সবকিছুর পেছনে প্রধান ভূমিকা এই ১৫ লাখ টাকার ছাগলের।
প্রসঙ্গত, গত ১৬ জুন দেশ রূপান্তরে ‘রাজস্ব কর্মকর্তার ছেলের অর্ধকোটির কোরবানি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর আলোচনায় আসেন এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান। ওই সংবাদে বলা হয়, এক ছাগলের দাম ১৫ লাখ টাকা, যা পরবর্তীতে বিক্রী হয় ১২ লাখ টাকায়। এই ছাগলটি ক্রয় করেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত। তার ছাগল কেনার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ছাগল কিনে আলোচনায় আসা ইফাত ছাগলের পাশাপাশি আরও চারটি গরু কিনেছেন ৩৭ লাখ টাকায়। সব মিলিয়ে এবার অর্ধকোটি টাকার কোরবানি দিচ্ছেন তিনি।