বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদের এমপি বলেছেন, আমরা পরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, ফলে এরকম দল থাকার কী দরকার! আরেক দল যদি তাকে নিয়ন্ত্রণই করে, তাহলে সে দলের অর্থ কী? এটা আংশিক সঠিক। আমরা নিয়ন্ত্রিত হয়েছি, এটা পার্শিয়ালি কারেক্ট; আমরা চেষ্টা করছি বেরিয়ে আসার জন্য।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় পার্টি সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বলেন, কথাগুলো আংশিক সত্য। সব সঠিক না হলেও অনেক কথার মধ্যে অনেক সঠিক ব্যাপার থাকে।
শনিবার দুপুরে বনানী কার্যালয়ে জাতীয় পার্টি ঢাকা মহানগর উত্তর আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জিএম কাদের এসব কথা বলেন। জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য শেরিফা কাদেরসহ দলের নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে জিএম কাদের বলেন, একটা কথা আমি বলতে চাই, আমাদের সবার স্মরণ রাখা উচিত, আমাদের দলের ব্যাপার মানুষের পারসেপশনটা খুব একটা ভালো নয়। এ সময় তিনি দুটি উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, এটা আমাদের সবার চিন্তা করতে হবে, এটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। একটা আর্টিকেলে বলা হয়েছে, বিরোধী দল হিসাবে আমাদের মানছেন না, যেহেতু আমরা সরকারি বদান্যতায়; মানে সরকারের ওপর নির্ভর করে সংসদে গেছি। সরকার আমাদের সংসদে নিয়ে গেছে। এটা আংশিক সত্য, সার্বিকভাবে এটা সত্য নয়।
জিএম কাদের বলেন, আমরা ফাইট করে গেছি, সব ঠিক আছে। উনারা শুধু নৌকাটা তুলে নিয়েছিলেন। কেননা উনারা বলেছিলেন, দলীয়করণের মাধ্যমে যেন নির্বাচন কলুষিত হয় বা দলীয়করণের কারণে বিভিন্নভাবে যে নিয়ম-কানুনগুলোকে ভঙ্গ করা হয়, সেটার জন্য উনাদের প্রতীক বা প্রার্থী না থাকলে সহজ হবে। কিন্তু উনারা প্রার্থী দিয়েছিলেন, বেশিরভাগ জায়গায় এবং প্রার্থীর সঙ্গে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে সমানভাবে।
তিনি বলেন, আরেকজন তার একটি লেখায় বলেছেন যে, আমরা পরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, ফলে এ রকম দল থাকার কী দরকার! আরেক দল যদি তাকে নিয়ন্ত্রণই করে, তাহলে সে দলের অর্থ কী? এটা আংশিক সঠিক। আমরা নিয়ন্ত্রিত হয়েছি, এটা পার্শিয়ালি কারেক্ট; আমরা চেষ্টা করছি বেরিয়ে আসার জন্য।
জিএম কাদের বলেন, বাস্তবতা হলো আমাদের এই নির্বাচন নিয়ে যখন আওয়ামী লীগ একটা বিভ্রান্তিকর বিবৃতি দিয়েছে যে, আমরা আওয়ামী লীগের ২৬টি সিট ছেড়ে দিলাম জাতীয় পার্টির ফেভারে। তারা একটা সিটও জাতীয় পার্টির ফেভারে ছাড়েনি। সব জায়গায় তাদের লোক দিয়ে রেখেছে, ফাইট করেছে এবং আমাদের লোক অনেক জায়গায় সেখানে যে কোনোভাবেই হোক পরাজিত করা হয়েছে বা করেছে। কিন্তু বিভ্রান্ত করা হয়েছে, আমাদের প্রার্থীও বিভ্রান্ত হয়ে গেছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এ সময় আরও বলেন, অনেকে যেমন বলছেন, আমাদের দল ভাগ হয়ে যাবে। দল ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা আমি এই মুহূর্তে, এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখি না। আরও একটা দল গঠন করতে পারেন, এরশাদ সাহেবের নাম দিয়ে, আদর্শ নিয়ে আরও ১০টা দল গঠন করতে পারেন তারা। নতুনভাবে দল গঠন করার প্রক্রিয়া আছে, করার পরে সেই দলটি নিবন্ধন করার প্রক্রিয়া আছে, সেটা যে কোনো লোক করতে পারেন। আমরা যে কাঠামোতে এগিয়ে যাচ্ছি সেখান থেকে ভেঙে নিয়ে নতুন করে দল গঠন করার এখনো সেই পরিবেশ বা পরিস্থিতি, সম্ভাবনা আমার চোখে পড়ছে না।
তিনি বলেন, অনেকে এটাকে মহাজোট বলেছে, অনেকে সিট ভাগাভাগি বলেছে। আমি প্রথম দিন থেকে বলেছি, এটা মহাজোট হয়নি, এটা সিট ভাগাভাগি হয়নি। এটা আওয়ামী লীগ ইচ্ছা করে করেছে অথবা ভুলক্রমে করেছে। আমাদের চরম ক্ষতি হয়েছে এটার কারণে। ভাঙন নিয়ে উদ্বিগ্ন নন জানিয়ে জিএম কাদের বলেন, সংসদে সংখ্যা কোনো ব্যাপার না। ছয়জন লোক কাঁপিয়ে দিয়েছিল গত সংসদে। দু-তিনজন লোক থাকলেই কাঁপিয়ে দেওয়া যায়। যদি সত্যি কথা বলা যায় এবং বলার সুযোগ পাওয়া যায়। অনেক কড়া কড়া কথা আমরা বলেছি কিন্তু আমাদের দল থেকে আরেকজন গিয়ে ঠিক উলটো কথা বলেছেন একই পার্লামেন্টে। যদি পাঁচ-সাতজন লোকও আমাদের বিপক্ষে বলতে থাকেন এবং আমরা যদি তাদের বের না করে দেই পার্টি থেকে, তাহলে সেই পার্টির কোনো গ্রহণযোগ্যতা জনগণের কাছে থাকে না।
জনগণ সত্যিকার অর্থে বিকল্প খুঁজছে জানিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে একটা শক্তিকে গ্রহণ করার জন্য জনগণ বসে আছে। জনগণ জানে, আওয়ামী লীগ চলে গেলে, বিএনপি এলে শুধু মানুষের চেহারার পরিবর্তন হবে। যে অনিয়ম, যে দুর্নীতি, বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার-অনাচার, টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি সবকিছু একই প্রক্রিয়ায়, একইভাবে চলতে থাকবে। তথাপি মানুষ পরিবর্তনের জন্য পরিবর্তন চাচ্ছে এই মুহূর্তে। সত্যিকারের যে পরিবর্তন সেটার জন্য যে দল, সেটা জাতীয় পার্টি দিতে পারবে যদি আমরা আপসকামিতা বাদ দিয়ে দেই।
গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে জিএম কাদের বলেন, ঢাকা মহানগরের আগের কমিটি যখন ভেঙে দেওয়া হয়েছে, তখন তারা প্রেস ক্লাবে মিটিং করে। ৩০-৪০ জন লোক নিয়ে আসে, যাদের বেশিরভাগই জাতীয় পার্টির লোক ছিল না, আমরা যতটুকু ভেরিফাই করেছি। বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল, কয়েকজন বহিষ্কৃত নেতা ছিলেন। হঠাৎ করে ঘোষণা দিলেন ৬৭১ জন গণপদত্যাগ করেছে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন কমিটি থেকে। এটা মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। এ রকম প্রচারণা আমি খুব কম দেখেছি।
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, এই নিউজগুলো আমি হলে ভেরিফাই করতাম; ৬৭১ জনের তালিকাটা দেন। অথবা এটা ভেরিফাই করা হয়নি, ঘোষণা করা হয়েছে। এরপরে কয়েকজন নেতাকর্মী শৌচাগার ব্যবহার করতে চেয়েছিল, তাদের বাধা দেওয়া হয়নি। সেটা প্রচারিত হলো জাতীয় পার্টির অফিস দখল হয়ে গেছে। দখল কতক্ষণ ছিল, কে করল, কেন করল। আমার মনে হয়েছে, এটা আরেকটু ভেরিফাই করা উচিত ছিল।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের উত্তরে জিএম কাদের প্রশ্ন রেখেছেন, আমরা কি মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছি? তিনি বলেন, বিচার চাওয়ার দাবিটা সঠিক। আপনি দেবেন আপনি সরকারে আছেন। যদি না দিতে পারেন, আপনি সরকার থেকে চলে যাবেন, আরেকজন যে দিতে পারবে তারাই আসবে।
তিনি বলেন, আমাদের কিছু কাজকর্মে সরকারি কিছু মন্ত্রীদের বক্তব্য-বিবৃতিতে; উনাদের আমি শ্রদ্ধা করি, অনেকেই শিক্ষিত মানুষ। হঠাৎ করে আমাদের মনে হয়, আমরা মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থার দিকে চলে যাচ্ছি কিনা? আইনমন্ত্রী হঠাৎ সেদিন একটা কথা বললেন যে, সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে প্রায় ১০৭ বার সময় নেওয়া হয়েছে, ১২ বছর চলে গেছে। তারপরও উনি বলছেন, আরও ৫০ বছর লাগলে দিতে হবে। উনার যুক্তি লাগলে দিতে হবে, সঠিক তদন্ত করতে হবে। এই কথাটাকে আমি এভাবে দেখেছি যে, মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থায় ভালো-মন্দ নির্ধারিত পেশিশক্তির মাধ্যমে। মানে জোর যার, মুল্লুক তার। (আইনমন্ত্রীর) কথাটা আমার কাছে অনেকটা ওই রকম মনে হয়েছে। কেননা, মধ্যযুগীয় সমাজ থেকে বর্তমান সমাজে পরিবর্তন হচ্ছে পেশিশক্তি ভালো-মন্দ নির্ধারণ করবে না। জোর যার, মুলুক তার নয়। জ্ঞান ও যুক্তি; তর্ক হবে, যে যুক্তি দিতে পারবে, জ্ঞানের কথা বলতে পারবে, আমরা সেটা গ্রহণ করব।
জিএম কাদের বলেন, বলা আছে জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড। কাজেই আরও ৫০ বছর যদি বিলম্বিত হয়, তাহলে তো এটা বিচারহীনতা হলো। সমাজকে কি আমরা বিচারহীনতা উপহার দিতে চাচ্ছি।
দায়-দায়িত্ব কার প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, আমরা তো ন্যায়বিচারভিত্তিক একটি সমাজ গঠন করার জন্য এই দেশ গঠন করেছি। দায়-দায়িত্ব তো সরকারের ছিল। সাগর-রুনীর সন্তান, আত্মীয়, সমাজের দাবি আছে আমি এটার বিচার চাই এবং আমার বিচার চাওয়াটা সঠিক দাবি। জবাবদিহিতা; আপনার ব্যর্থতা, আপনি কী করছেন? গায়ের জোরে, আমি পাওয়ারে আছি, আমি যা বলব তাই মানতে হবে, তাই লিখতে হবে, আমি বলে দিলাম আরও ৫০ বছর লাগলে দিতে হবে। তাহলে জবাবদিহিতা কোথায়?