‘আঁই মা হারে ডাইক্কুম। ঘরত থাহিয়েরেও তুই মরি গেলিগই মা। ও আল্লাহ তুই আর মারে কিরল্লাই তুলি ললি। আর মারে রাখি তুই আরে ক্যা লই ন গলি। আঁর মা তো কিয়ার হতি নগরে। অ মারে মা।’
রান্নাঘরের খুঁটি ধরে কান্না করতে করতে এসব বলছিলেন ২১ বছর বয়সী ইব্রাহীম। মায়ের মৃত্যু মানতে পারছেন না তিনি। ইব্রাহীম মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে নিহত বাংলাদেশি হোসনে আরার ছেলে। গতকাল সোমবার মৃত্যু হয় হোসনে আরার।
মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে হোসনে আরার বাড়িতে গেলে দেখা যায়, মায়ের মৃত্যু শোকে বারবার মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন ইব্রাহীম। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বেতবুনিয়া সীমান্ত সংলগ্ন জলপাইতলী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন হোসনে আরা।
ওইদিন হোসনে আরার সঙ্গে মৃত্যু হয়ে নবী হোসেন নামের এক যুবকের। তিনি রোহিঙ্গা নাগরিক। বালুখালী আশ্রয়শিবির থেকে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হোসনে আরার বাড়িতে এসেছিলেন নবী হোসেন। এ সময় হোসনে আরার নাতনি নুশরাত মনি (৬) বা পায়ে আঘাত পায়।
এলাকাবাসীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বাদশা মিয়া বাড়ির পাশেই একটি চায়ের দোকান করেন। তাদের দুই সন্তান। বড় ছেলে শফিউল আলম (৩০) ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার চালক আর ছোট ছেলে ইব্রাহিম উখিয়া ডিগ্রি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। তিনি অবসরে বাবার চায়ের দোকানে বসেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সদর হাসপাতাল মর্গ থেকে হোসনে আরার মরদেহ নিয়ে এসেছেন স্বামী বাদশা মিয়াসহ স্বজনরা। শেষবারের মতো তাকে একপলক দেখতে ভিড় করছে আত্মীয়-স্বজনসহ প্রতিবেশীরা। তবে এই ভিড় থেকে খানিকটা দূরে ছোট ছেলে ইব্রাহীম যে রান্নাঘরে হোসনে আরা নিহত হয়েছেন সেই ঘরের খুঁটি ধরে কান্না করছেন। আর তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন চাচা আব্দুর রহিম ও চায়ের দোকানের কর্মচারী কিশোর আবুল বশর।
আব্দুর রহিম বলেন, ‘ইব্রাহীম খুব আদরের ছিল হোসনে আরার। অল্প বয়সে বিয়ে করে ফেললে সবাই ইব্রাহীমকে তাড়িয়ে দেন। তবে মায়ের জেদের কাছে সবাই হেরে গিয়ে ইব্রাহীমকে বাড়িতে জায়গা দিতে বাধ্য হন পরিবারের অন্যান্যরা। এ কারণে ইব্রাহীম বেশি আহাজারি করছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ঘরে থেকেও কেউ নিরাপদ নয়। সবাইকে মরতে হবে। তবে এ মৃত্যু মানতে পারছি না। সরকারের এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ।’
মর্টার শেল বিস্ফোরণের সময় ঘটনাস্থলে থাকা বাদশার চায়ের দোকানের কর্মচারী আবুল বশর বলেন, ‘গতকাল সোমবার যখন মর্টারশেল বিস্ফোরণ হয় তখন আমি রান্নাঘর থেকে মাত্র ১০/১২ হাত দূরের নলকূরেপ গোসল করছিলাম। মর্টার শেলের আঘাতে হোসনে আরা ‘আল্লাহ’ বলে ডাক দিয়ে মাটিতে লুঠিয়ে পড়েন। এরপর আমি তাকে হাতে ধরি। ওই সময় রান্নাঘর থেকে রক্তের স্রোত বয়ে যায়। উনার শরীর থেকে রক্ত ছিটকে আমার শরীরেও এসে পড়ে।’
স্থানীয় ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘সীমান্তবাসী চরম আতঙ্কে রয়েছে। ঘরে থাকা মানুষও নিরাপদ নয় এখন।’
ঘুমধুম পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইন্সপেক্টর মাহফুজ ইমতিয়াজ ভুইয়া বলেন, ‘ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’