এস আলম সুগার মিলে নিভে এসেছে আগুন। পোড়া অপরিশোধিত চিনি মিশ্রিত বিষাক্ত তরলও ছড়িয়ে গেছে কর্ণফুলীতে। অতঃপর পা মাড়ালেন পরিবেশ অধিদপ্তরের স্থানীয় বড় কর্তা! তাও সবার বড় যিনি তার যাওয়ার সময় হয়নি এখনো। তবে দেয়াল ফুটো করে কর্ণফুলীতে ছাড়া ওই ‘বিষাক্ত’ পানির নমুনা সংগ্রহ করে ‘দায়’ সেরেছে তাঁর অধীন একটি টিম। অথচ অগ্নিকাণ্ডের পরদিন মঙ্গলবার সকাল থেকেই বিষাক্ত তরল খাল-নদীতে ছড়িয়ে পড়ার ভয়াবহতা উঠে আসছিল বিভিন্ন গণমাধ্যমে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগরে কারখানাটির অবস্থান। সোমবার বিকেলে কারখানাটিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ঘটনার তিনদিনের মাথায় ‘ঘুমে’ থাকা পরিবেশ অধিদপ্তরের ফিরেছে ‘হুঁশ’। গঠন করলো একটি তদন্ত কমিটি।
জানা গেছে, অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালকের ভার সামলাচ্ছেন চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস। উপ-পরিচালকের পদে রয়েছেন মো. ফেরদৌস আনোয়ার। বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) সকালে প্রথমবারের মতো ঘটনাস্থলে যান উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার।
এদিকে ঘটনাস্থলে একবারের জন্যও পা না মাড়ানো হিল্লোল বিশ্বাসকে আহ্বায়ক করেই তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদের স্বাক্ষরে এক অফিস আদেশে বৃহস্পতিবার ওই কমিটি গঠন করা হয়। বিশেষজ্ঞ সদস্যদের সঙ্গে সচিব হিসেবে রয়েছেন উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার।
অফিস আদেশে কমিটিকে ‘সংশ্লিষ্ট এলাকা সরেজমিন পরিদর্শনপূর্বক পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব নিরূপণ, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে বর্ণিত ক্ষতি প্রশমন ও প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ/প্রস্তাবনা দেয়ার জন্য’ও বলা হয়েছে।
কমিটিতে বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্টি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইনস্টিটিউট অব রিভার, হারবার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের পরিচালক অধ্যাপক ড. আসিফুল হক।
শুরু থেকে যদি পরিবেশ অধিদপ্তর সক্রিয় ভূমিকা পালন করতো তাহলে এত ক্ষতিকর বর্জ্য নদীতে যেতে পারতো না বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আলীউর রহমান।
বৃহস্পতিবার কর্ণফুলী নদীর পানিদূষণ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের প্রতিবাদে এক কর্মসূচিতে তিনি বলেন, ‘এস আলমের চিনি কারখানার আগুনের কারণে কর্ণফুলী নদী স্মরণকালের ভয়াবহ দূষণের শিকার হয়েছে। জলজ প্রাণী, উদ্ভিদসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়েছে। মরা মাছ ভেসে আসছে। এমন পরিস্থিতি স্মরণকালে কর্ণফুলী নদীতে আর হয়নি।’
‘এর জন্য এস আলম কর্তৃপক্ষ দায়ী, একইসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরও দায়ী। পরিবেশ অধিদপ্তর যদি শুরু থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতো, তাহলে এত ক্ষতিকর বর্জ্য নদীতে যেতে পারতো না। দায়িত্বে অবহেলার জন্য আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরের জবাবদিহিতা দাবি করেছি।’-যোগ করেন আলীউর।
পরিবেশ আন্দোলক আলীউর রহমান আরো বলেন, ‘এস আলম গ্রুপের কাছ থেকে এমনভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে শিল্পকারখানাগুলো খাল, নদী ও জলাশয় দূষণ করার সাহস আর না পায়।’
এদিকে দ্বারগোড়ায় ঘটনাস্থল হলেও পোড়া চিনির বিষাক্ত পানি কর্ণফুলীসহ আশপাশে ছড়িয়ে যাওয়ার খবরে পরিবেশ অধিদপ্তরের স্থানীয় ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা কেন গেলেন না-তা জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল তাদের মোবাইল ফোনে। বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) হিল্লোল বিশ্বাস। আর ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ারের।
তবে এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় মো. ফেরদৌস আনোয়ার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘অধিদপ্তরের ল্যাব থেকে একটি টিম কারখানা থেকে বের হওয়া তরল ও নদীর পানির নমুনা সংগ্রহ করেছে।’
ক্ষতি প্রসঙ্গে মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেছিলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে পুড়ে যাওয়া চিনির কাঁচামাল এবং ফায়ার সার্ভিসের পানি একসাথে হয়ে সেগুলো নদীতে যাচ্ছে। এতে নদীতে একটু ইম্পেক্ট তৈরি হবে। নদী যেহেতু প্রবাহমান এবং জোয়ার-ভাটার নদী; এটা যখন (পানি) ডেসপার্চ হয়ে যাবে তখন আস্তে আস্তে প্রভাবটা কমে যাবে।’
প্রসঙ্গত, গত সোমবার (৪ মার্চ) বিকেল ৩টা ৫৩ মিনিটে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের এই চিনিকলের একটি গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বিকেল ৪টার দিকে খবর পেয়ে শুরুতে দুটি ইউনিট, পরে আরও ৫টি ইউনিটসহ মোট ৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তবু আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় যুক্ত হয় আরো ৭টি ইউনিট। সব মিলিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৪ ইউনিট কাজ করে। রাত ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। যুক্ত হন সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরাও।